কথিত স্টেশন মাস্টারের নেতৃত্বে জুয়ার আসর

বিশেষ প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ ।।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। কিশোরগঞ্জের নীলগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে স্টেশন ধরে চলে গেছে একটি লোকাল ট্রেন। ট্রেন যাওয়ার পর প্ল্যাটফর্মে লোকজন কমে গেছে। চার দিকে কিছুটা অন্ধকার। দুই মিনিট পরই স্টেশনে এসে জড়ো হলো ২০-২৫ যুবক। তারপর স্টেশনের উত্তর দিকের একটি কক্ষ দখলে নিয়ে জুয়ার আড্ডায় মত্ত হয় তারা।

এলাকাবাসী জানান, এ আড্ডা চলবে রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর এই স্টেশনে সরেজমিন এ দৃশ্য চোখে পড়ে। রাতেই যে শুধু এখানে জুয়ার আড্ডা বসে এমন না। অভিযোগ রয়েছে, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা, বেলা ১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা, সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত, এভাবে তিন-চার পালায় প্রায় প্রতিদিনই জুয়ার আড্ডা বসে এ স্টেশনে। জুয়াড়িদের জন্য এখন এই স্টেশন সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। পুলিশের লোকজনও এখানে অভিযান চালায় না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্টেশনসংলগ্ন বড়কাপন গ্রামের গোলাম মোস্তফা টাকার বিনিময়ে প্রতিদিনই স্টেশনে এ জুয়ার আড্ডা বসাচ্ছে। নিজেকে ‘স্টেশন মাস্টার’ পরিচয় দিয়ে গোলাম মোস্তফা স্টেশনের বিভিন্ন কক্ষ ব্যবহার করে করছে মাদক ব্যবসায়। স্টেশনের পুরো জমি ভোগ করছে। রেলওয়ের পুরনো বিল্ডিংয়ের ইট, টিনের চালা, পুরনো লোহা ও গাছপালা সব বিক্রি করছে সে। এসবের ভাগ পায় অনেকে।

Kishoreganj-(Rail-Station)

নীলগঞ্জ স্টেশনের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মচারী জানান, নীলগঞ্জ স্টেশনে কি-ম্যানসহ এ বিভাগের মোট পাঁচজন কর্মরত আছেন। গোলাম মোস্তফার অপকর্ম দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন তারা। রেলস্টেশনের কোনো কক্ষে প্রবেশ করলে মোস্তফার কাছ থেকে চাবি নিয়ে ঢুকতে হয়। এসব নিয়ে মুখ খুললেই তাদের চাকরি খোয়ানোর ভয় দেখানো হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ স্টেশনে রেলওয়ের জায়গায় ৪০-৪৫টি দোকান রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ছয়টি দোকান রেলওয়ের ভূমি বিভাগ থেকে লাইসেন্স নেয়া। বাকিগুলোর লাইসেন্স নেই। ওই দোকানগুলোর টাকা গোলাম মোস্তফা হাতিয়ে নিচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্টেশনের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের লাইসেন্স করতে হয়নি। মোস্তফা ভাইকে মাসে মাসে কিছু টাকা দেই, তিনিই আমাদের দেখভাল করেন। কোনো সমস্যা হয় না।’ এভাবে ব্যবসা করা তো বৈধ না, এ প্রশ্নের জবাবে কয়েকজন বলেন, ‘কেন বৈধ অইবো না, এ টাকার ভাগ তো রেলওয়ের লোকজনও নেয়। কিশোরগঞ্জ থেকে আইসা দেলোয়ার সাব এ টাকার ভাগ নেন।’

কে এই গোলাম মোস্তফা। আর কে এই দেলোয়ার সাব? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরে নীলগঞ্জ স্টেশনে কোনো স্টেশন মাস্টার নেই, নেই কোনো পয়েন্টসম্যান, পোর্টারের দায়িত্বেও নেই কেউ। এ অবস্থায় কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী মো: দেলোয়ার হোসেনকে স্টেশন মাস্টার হিসেবে এ স্টেশনে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তিনিই দেলোয়ার সাব হিসেবে পরিচিত। তিনি (দেলোয়ার হোসেন) দায়িত্ব পাওয়ার পর বড়কাপন গ্রামের আবদুল হেলিমের ছেলে পূর্বপরিচিত গোলাম মোস্তফাকে রেলওয়ের অনুমতি ছাড়াই স্টেশনের টিকিট কাটা, মালামাল বুকিংসহ স্টেশনের সম্পত্তি ‘রক্ষার’ দায়িত্ব দেন তিনি। দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ‘দায়িত্ব’ পেয়ে গোলাম মোস্তফা নিজেকে ‘স্টেশন মাস্টার’ পরিচয় দিয়ে রাজত্ব করছেন। এ বিষয়ে গোলাম মোস্তফার সাথে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমি এক সময় মাস্টার রোলে এ স্টেশনে কাজ করতাম, সেটা ২০-২৫ বছর আগের কথা। এখন দেলোয়ার সাবের কথায় এ স্টেশন চালাচ্ছি। আমি নিয়োগপ্রাপ্ত না বা মাস্টাররোলেও কাজ করছি না, এটা সত্য। তবে আমি না থাকলে স্টেশন খালি পড়ে থাকত। একটা কুকুরও আসত না। জনগণের স্বার্থেই আমি এ স্টেশনে আছি। আগে এখানে কিছু উচ্ছৃঙ্খল পোলাপান আসত, এখন আমি আসতে দেই না। আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ দিছে সব মিথ্যা।’

Kishoreganj-(Rail-Station)2

এ ব্যাপারে গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টায় কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশনে গিয়ে কথা হয় বুকিং মাস্টার দেলোয়ার হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, ‘কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের বাইরেও যশোদল ও নীলগঞ্জ স্টেশনে আমাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এক সাথে তিনটি স্টেশনে দায়িত্ব পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাই নীলগঞ্জ স্টেশনে গোলাম মোস্তফাকে ‘লেবার’ হিসেবে আমি দায়িত্ব দিয়েছি।’ তিনি তো এখানে জুয়ার আসর বসাচ্ছেন, তা ছাড়া রেলওয়ের নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ না, মাস্টার রোলেও নিয়োগ না। স্টেশনে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট আছে, আছে কোটি কোটি টাকার টিকিটের হিসাব। আপনার সমস্যার কথা তো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন, বাইরের একজনকে এভাবে সবকিছুর দায়িত্ব দেয়া কি ঠিক? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মোস্তফা আমার বিশ্বস্ত লোক, কোনো ডকুমেন্ট হারালে তো দায়দায়িত্ব আমিই নেবো। তাতে আপনার কী? কিছু মানুষ হিংসা করে মোস্তফার বিরুদ্ধে কথা বলছে, আমার বিরুদ্ধেও মিথ্যা বলছে। মোস্তফা এখানে না থাকলে পুরো স্টেশনই চুরি হয়ে যেত।’

এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো: জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘পরিবহন ও বাণিজ্যিক বিভাগে লোকবল সঙ্কটে অনেক স্টেশনই দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ আছে। কয়েকটি আংশিক চালু আছে। নীলগঞ্জ এমনই একটি স্টেশন। লোকবল পদায়নের মাধ্যমে স্টেশনগুলো চালু করলে এক দিকে যেমন রেলে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে, অপর দিকে স্টেশন এলাকার পারিপার্শ্বিক অবস্থারও উন্নতি হবে।’

সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১৬ এপ্রিল ২০১৬

Similar Posts

error: Content is protected !!