সোনিয়া বশির কবির। মাইক্রোসফট বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এর আগে ছিলেন ডেল-এর কান্ট্রি ম্যানেজার। দেশীয় উদ্যোক্তাদের উন্নয়নের প্ল্যাটফর্ম টাই বাংলাদেশের তিনি ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট। দেশের প্রযুক্তিতে তিনি অগ্রণী ভূমিকাও পালন করছেন। বাংলাদেশ ওমেন ইন টেকনোলজির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানিয়েছেন, তার প্রযুক্তি জীবন, কাজের পদ্ধতি, লক্ষ্য ইত্যাদি বিষয়ে। স্বপ্ন দেখেন একটি পাইরেসি সফটওয়্যারমুক্ত বাংলাদেশের। আলাপচারিতার বিস্তারিত তুলে ধরা হলো :

প্রযুক্তিকে পেশা হিসেবে নেয়ার পেছনের কারণটি জানতে চাই।
সোনিয়া বশির কবির : পড়াশোনার জন্য আমি সিলিকন ভ্যালিতে (যুক্তরাষ্ট্র) চলে যাই। সিলিকন ভ্যালি ইজ দ্য হার্ট অব টেকনোলজি ইনোভেশন। ওখানেই আমার ব্যাচেলর করেছি। এমবিএ করা। ওখানে আমি ১০ বছরের বেশি চাকরি করেছি। মনে প্রাণে প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িয়ে যাই। সুতরাং এটাই আমাকে প্রযুক্তির দুনিয়ায় নিয়ে গেল।
আপনি দেশে এবং বিদেশে বড় বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। দেশ এবং বিদেশে কাজের মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে?
আমার মনে হয় বিদেশে কাজের ধরণ অনেক স্ট্রাকচার্ড, অনেক প্রসেস ওরিয়েন্টেড। বাংলাদেশে এসে দেখেছি এসব নেই। আমরা অনেক ইয়াং দেশ। ১৯৭১ এ আমাদের জন্ম। আমার মনে হয় স্ট্রাকচার, প্রসেসের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
আমাদের জানা আছে যে, আপনি একটি প্রতিষ্ঠানে বেশিদিন কাজ করেন না। বিশেষ কোনও কারণ আছে কি?
আমি যখন আমেরিকায় ছিলাম তখন সান মাইক্রো সিস্টেমসে কাজ করেছি ৮ বছর। সান এতো বড় ছিল যে, সানের মধ্যেই আমি চাকরি চেঞ্জ করতে পারতাম। এই যেমন বাংলাদেশে ডেলে কাজ করেছি, কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে। এখন মাইক্রোসফট বাংলাদেশে আছি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। আসলে এর উপরে তো আর যাওয়ার জায়গা নেই। এখন আমি আরাম পেয়ে বসে থাকতে পারব না। অন্যকেও তো জায়গা করে দিতে হবে।
নতুন কোনও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেয়ার আগে কী টার্গেট সেট করে নেন?
আমি নিজের কাছে গোল (লক্ষ্য, উদ্দেশ্য) রাখি। কোথাও যোগ দেয়ার আগে আমি জিজ্ঞেস করে নিই, তোমরা আমাকে নিচ্ছ, তোমাদের পরিকল্পনা কি? সেটা তারা আমাকে জানায়। আমি সেই মতে কাজ করি। হতে পারে সেটা ৩ বা ৪ বছর। আমি সেটা শেষ করে যাই।
বিশ্বখ্যাত সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট অনেকদিন হলো বাংলাদেশে অফিস পরিচালনা করছে। মাইক্রোসফট বাংলাদেশের লক্ষ্য কি?
মাইক্রোসফট বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো ‘টু মেক আ ডিফারেন্স ইন দ্য লাইভস অব পিপল অব বাংলাদেশ।’ এটা অনেক জেনারেল বললাম। কারণ, টেকনোলজি ইজ ইন এনি ব্লাড। আমরা সবাই প্রযুক্তি ব্যবহার করি। শুধু পেশাগত কারণে যে তা নয়। এটা আমাদের জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে। মাইক্রোসফট বলছে, ওয়ান্ট টু বি আ পার্ট অব এভরিবডিস লাইফ। সবার জীবনের একটা অংশ হয়ে যেতে চায় মাইক্রোসফট।
দেশে মাইক্রোসফটের অরিজিনাল (লাইসেন্সড) সফটওয়্যারের ব্যবহার বৃদ্ধিতে আপনার উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাই।
আমরা অনেকগুলো কাজ করেছি। শুনেছেন বোধ হয়, এরই মধ্যে আমরা উইন্ডোজ অ্যাম্বাসেডর নির্বাচন করেছি। মাইক্রোসফটের পাইরেসি ফাইট করার জন্য আমাদের দুটো হাতিয়ার রয়েছে। এর একটা হলো উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম। বলা হচ্ছে, তোমার উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম এইট বা সেভেন যাই থাকুক, আসল কিংবা কপি। উইন্ডোজ ১০ ডাউনলোড করা যাবে বিনামূল্যে। এটা হলে পাইরেসি এমনিতেই চলে যাবে, কারণ ফ্রি সবাই নেবে। দ্বিতীয়ত হলো অফিস-৩৬৫। আগে এটার দাম ছিল ৩০ হাজার টাকা। এখন মাসে ৫০০ টাকা (অন দ্য ক্লাউড)।
দীর্ঘদিনের অভিযোগ, মাইক্রোসফটের অরিজিনাল সফটওয়্যারের দাম বেশি, এ কারণে লাইসেন্সড সফটওয়্যারের ব্যবহারও কম। বেশিরভাগ ব্যবহারকারী কপি সফটওয়্যারে আগ্রহী।
এখন মাইক্রোসফটের সফটওয়্যারের দাম অনেক কমে গেছে। ৩০ হাজার টাকা থেকে চলে এসেছে ৬ হাজার টাকায়। হয়তো অনেকে বলতে পারেন, আমার ইন্টারনেট নেই, ক্লাউডে কিভাবে যাব? তাদের জন্য বলি, আমাদের দুটি অপশন রয়েছে। অফিস-৩৬৫–এর একটি রয়েছে ডাউনলোডেবল ভার্সন। আরেকটি রয়েছে ক্লাউড ভার্সন।
দেশের কতসংখ্যক কম্পিউটারে লাইসেন্সড উইন্ডোজ ব্যবহার হয়? কোনও ডাটা আছে কি?
আমাদের দেশে যত সংখ্যক কম্পিউটার ব্যবহার হয় তার মাত্র ১০ শতাংশে অরিজিনাল (লাইসেন্সড) সফটওয়্যার ব্যবহার হয়। বাকি ৯০ শতাংশ কস্পিউটারে পাইরেটেড বা কপি সফটওয়্যার ব্যবহার হয়। আমার লক্ষ্য হচ্ছে, দেশে পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহারের হার শূন্যে নামিয়ে আনা। এ লক্ষ্যে আমি কাজ করছি। আগামী তিন বছরে আমি ১০ শতাংশকে শতভাগে উন্নীত করতে চাই। ৩ বছরে পাইরেটেড সফটওয়্যারের ব্যবহার শূন্যে নামিয়ে আনব।
টাই সম্পর্কে জানতে চাই
সিলিকন ভ্যালির দ্য ইন্দাস এন্টারপ্রেনার্স-সংক্ষেপে হলো টিআইই বা টাই। আমি হলাম টাই বাংলাদেশের ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট। টাইয়ের কাজ হলো এন্টারপ্রেনারদের উন্নয়ন করা। আমাদের এখানে ৫০ জন তালিকাভুক্ত সদস্য রয়েছে। আমাদের কাজ হলো উদ্যোক্তাদের আরও কীভাবে উন্নয়ন করা যায় সেসব নিয়ে কাজ করা।
আমাদের দেশে নারীরা সাধারণত পেশাগত ক্ষেত্রে কি কি ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন?
আমি বলব যে, বাংলাদেশের নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তা হলো তার পরিবার, বাবা-মার সাপোর্টের অভাব। আমার সৌভাগ্য যে, এসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আমাকে হতে হয়নি। আমার বাবা-মা, আমার স্বামী, আমার বাচ্চারা –এটাই যদি কেউ ‘পিস অব মাইন্ড স্ট্রেন্থ’ পায় তাহলে তার মানসিক শক্তি, দৃঢ়তা বেড়ে যায়। তখন কোনও চ্যালেঞ্জ আর চ্যালেঞ্জ থাকে না।
বাংলাদেশের নারীদের আপনি কোথায় দেখতে চান? নারীর অগ্রগতির বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন বা মূল্যায়ন করেন?
আমি এমনিতেই বাংলাদেশের নারীদের ভালো অবস্থায় দেখছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, সংসদের স্পিকার সবাই নারী। এটা আমার ভালো লাগে। এছাড়া অনেক দেশীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী, পরিচালক ইত্যাদি পদে নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। এগুলোই অগ্রগতির সূচক বলে আমি মনে করি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : হিটলার এ. হালিম
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন