কিশোরগঞ্জে মায়ের হাতে প্রাণ দিল দেড় বছরের শিশু

মোঃ আল আমিন, বিশেষ প্রতিনিধি (কিশোরগঞ্জ)
আবার মায়ের হাতে শিশুহত্যার ঘটনা ঘটল! কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মারিয়া ইউনিয়নের প্যারাভাঙ্গা গ্রামে শিশুটির নানার বাড়িতে আজ শনিবার ৫ মার্চ দুপুরে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। পুলিশ শিশুহত্যায় অভিযুক্ত মা সালমা খাতুনকে (৩৫) গ্রেফতার করেছে। পুলিশের কাছে তিনি তার দেড়বছর বয়সী ছেলে মাহাথিরকে দা দিয়ে গলা কেটে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন।
এ ঘটনায় প্যারাভাঙ্গা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। হতভম্ব হয়ে পড়েছে এলাকাবাসী ও স্বজনেরা। মায়ের হাতে নিহত মাহাথির ও অভিযুক্ত সালমাকে দেখতে শত শত এলাকাবাসী ভিড় করেন। সালমা প্যারাভাঙ্গা গ্রামের আশরাফ আলীর মেয়ে।

আটককৃত মা সালমা খাতুন
আটককৃত মা সালমা খাতুন

পারিবারের লোকজন জানিয়েছেন, প্রায় ১৬-১৭ বছর আগে সালমা খাতুনের বিয়ে হয়েছিল কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার গুজাদিয়া ইউনিয়নের টামনি আকন্দপাড়া গ্রামে। স্বামী আবুল কালাম কৃষিকাজ করেন। মাহাথিরের জন্মের পর মা কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় গত একমাস আগে বাবার বাড়ির লোকজন সালমাকে চিকিৎসার জন্য প্যারাভাঙ্গা নিয়ে আসে। মাহাথির ছোট বলে তাকেও নিয়ে আসা হয়। এখানেই সালমার ডাক্তারি ও কবিরাজি চিকিৎসা চলছিল।
আটক সালমা পুলিশকে জানিয়েছেন, সকালে প্রতিদিনের মতো নানার বাড়ির বসতঘরে খেলা করছিল তার ছেলে মাহাথির। তখন ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। এ সময় ঘরে কেউ ছিল না। ঘুম থেকে উঠে তিনি একটি দা নিয়ে শিশুটিকে গলা কেটে হত্যা করেন। পরে রক্তাক্ত দা নিয়ে বাইরে গেলে স্বজনদের চোখে পড়ে বিষয়টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সালমারা সাতবোন, অভাবের সংসার। স্বামীর আর্থিক অবস্থাও ভালো না। প্রায়ই তাকে বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকতে হতো। এ বিষয়টি বাবার বাড়ির লোকজনও ভালোভাবে নিত না। এসব কারণেও সালমা হতাশাগ্রস্ত ছিলেন।
নিজের সন্তানকে কেন হত্যা করলেন সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে সালমা বলেন, ‘আইজ মাতার মইদ্যে কী অইছে কইতাম ফারিনা, বাচ্চারে মইরালছি। জামাই খালি বাফের বাড়িতে ফালাইয়া থয়। বইনেরা খালি সারাদিন বহে। এনো কেরে খাই থাহি। কামতো কইরাইলছি অহন তো আমার ফুতেরে আর ফাইতাম না।’
সরেজমিন প্যারাভাঙ্গা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সালমার বোন, মা-সহ আত্মীয়স্বজনের আহাজারি। এলাকার লোকজনও এ দৃশ্য দেখে চোখের পানি ফেলেন। শিশু মাহাথির ও তার মাকে দেখতে শত শত গ্রামবাসী ওই বাড়িতে ভিড় জমায়।
সালমার চাচাতো বোন বকুলা ও দোলেনা জানান, এ সময় তারা ঘরে ছিলেন না। সালমা যখন রক্তাক্ত দা নিয়ে ঘর থেকে বের হয় তখন বিষয়টি নজরে পড়ে তাদের।
তবে সালমা খাতুন যে মাঝে মাঝে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তা জানিয়েছেন বাবা ও স্বামীর বাড়ির লোকজনসহ এলাকার লোকজনও। জানা গেছে, তিনি শিশু জন্ম দেয়ার পরই মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। তার সুরাইয়া (১৫), কলি ও তাইয়েবা (৪) আরো তিনটি মেয়ে আছে। তাদের জন্মের পরও তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। পরে দীর্ঘদিনের চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন। এরপর মাহাথির জন্মের পর থেকে তিনি আবার অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। একমাস আগে স্বামীর বাড়ি করিমগঞ্জের এ শিশুটিকেই তিনি একবার পানিতে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বজনরা তাৎক্ষণিক দেখে ফেলায় শিশুটিকে তখন জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তবে গতকাল মায়ের সঙ্গে তার ওই তিন মেয়ে ছিল না। তারা তাদের বাবার বাড়ি করিমগঞ্জে অবস্থান করছে।
ঘটনাস্থলে স্বামী আবুল কালামকে পাওয়া না গেলেও তার চাচাতো ভাই পিডিবির কর্মচারি একেএম আজিজুল হক শামীম ও মো. মনসুর আলম বলেন, সন্তান জন্ম দেয়ার পরই সালমা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তার অন্য মেয়েগুলো জন্মের সময়ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল সে। তবে ওইসময় এতটা পাগলামি করত না। চিকিৎসার পর ভালো হয়ে যেত।
মারিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। খবর পেয়েই আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে সালমাকে আটক করার ব্যবস্থা করি। এ সময় সে ভাবলেশহীন ছিল। পুত্রহত্যার বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হলেও সে তখন নির্বিকার থাকে।
কিশোরগঞ্জ মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মো. মোর্শেদ জামান জানিয়েছে, সালমা তার শিশুকে হত্যার কথা নিজেই স্বীকার করেছে। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে। মামলার পর এ বিষয়ে তদন্তে নামবে পুলিশ।

Similar Posts

error: Content is protected !!