ছেলেবেলা

হেমন্ত ঋতু  শেষের দিকে। নদীর ঐ পর্যন্ত তাকালে দেখা যায় শস্য বিহীন খালি মাঠ। মাঠে মাঠে এক ধরনের প্রসারিত শান্তি। চোখ বন্ধ করলেই. মনে এক ধরনের শান্তি অনুভব করা যায়। আকাশের  আলোটা খুব দ্রুত মিলিয়ে যায়। শীতটা মনে হয় এবার খুব তাড়াতাড়ি নামবে। বিকেল বেলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অহনা এ কথাগুলো ভাবছে। একদিন সাহস করে অহনা ঐ পর্যন্ত যাবে। একা যাওয়া যাবে না,  বন্ধুদের সাথে যাবে। অহনার কোন মেয়ে বন্ধু নাই। দীপু, আবীর, ওদের বয়সটা অহনার কাছাকাছিই হবে। তবুও দীপুটা সবসময় একটা বড় বড় ভাব নিয়ে থাকে। সেদিন যেমন দীপু বললো, অহনা তুই মেয়ে বলে হুটহাট ঐ পারে যেতে পারিসনা। অহনার খুব রাগ হয়েছিলো। বড়রা যখন কথা বলে, তখন আদেশের স্বরে বলে, অহনা বড়দের কথা বলার সময় থাকতে নেই। তবে ওর খালাতো বোন ইতি আর রফিক ভাই প্রায় সময় বিকেলে কথা বলে। অহনার একটু দুরে দাড়ানোর অনুমতি মিলে, কিন্তু বলা থাকে বড়রা কেউ আসলে অহনা যেন গলা কাশি দেয়।  অহনাকে তখনই শুধুমাত্র গুরুত্ব দেয়। যেন কোন রাজকর্ম করছে এমন একটা ভাব চোখে মুখে। অহনা কয়েকবার চেষ্টা করেছে ওরা কি কথা বলে শুনার জন্য। এতো নিচুস্বরে কথা বলে যে অহনা বুঝতে পারেনা। এ কথার নাম দিয়েছে মিটিমিটি কথা বা হাসিহাসি কথা। অহনা মাঝেমধ্যে ভাবে ও কি বড় হয়ে এমনভাবে কথা বলবে। পরক্ষণে ভাবে না সেটা হয় কি করে, তখন ওর কত্তো কাজ থাকবে। অহনার মাথায় ঢুকে না দুজন মানুষ কিভাবে মুখোমুখি বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে।

soaijani
নদী পারাপারের জন্য আট আনা পয়সাই যথেষ্ট। তবু অহনা এক টাকা সাথে নিয়েছে। বলা যায়না নৌকার মাঝি যদি সবার সামনে টাকাটা চেয়ে বসে থাকে। তখন লজ্জায় পড়তে হবে। দীপুকে নিয়ে অহনা নৌকায় উঠলো বেলা তিনটার দিকে। দুঘন্টার মধ্যে ঘুরেফিরে চলে আসতে হবে। সাড়ে পাচটায় সন্ধ্যা নামে । আবীর টা শেষ পযর্ন্ত আসেনি। অহনার সাথে পেট ব্যাথা বলে গুল মেরেছে। আবীর হয়তোবা ভেবেছে ও না গেলে অহনার যাওয়া হবেনা। অহনা নৌকার ঠিক মাঝখানে বসেছে। বিশ মিনিটির মাথায় ঐ পাড়ে পৌছালো অহনারা। পঞ্চাশ পয়সার সিকিটা মাঝির হাতে না দিয়ে নামার সময় তীরে ফেলে দিয়ে এক দৌড়। বলা যায়না যদি এক টাকাই ভাড়া রেখে দেয় তবে ফেরার সময় হাতে কিছু থাকবেনা। অহনা দৌড়াচ্ছে দীপুকে সাথে নিয়ে। নদীর তীর থেকে একটু ভেতরের দিকে চলে গেল।জমির আইল ধরে হাটছে ওরা। দীপু বললো, অহনা তুই এদিকে থাকিস আমি একটু কলঘর থেকে ঘুরে আসছি। দীপু অহনার উত্তরের অপেক্ষা না করে দিলো দৌড়। অহনা একা একা একটু অস্বস্তি লাগলো।  জমিতে পেয়াজ রসুনের নতুন ডগা মিলেছে। দেখতে বেশ লাগে। কেমন যেন একটা নরম নরম ভাব। কিছু ছিড়ে জামার কুঁজোতে রাখলো। আর সাথে কিছু মিষ্টি কুমড়ার ফুল। অহনা কলঘরের দিকে হাটছে। বেশী দুর না, মিনিট পনেরোর মতো লাগবে। দীপুর কাছে অনেক কলঘরের গল্প শুনেছে। নদী থেকে একটা মেশিনের সাহায্যে কলঘরে পানি তুলা হয়। এরপর এই পানি সমস্ত জমিতে দেয়া হয়। দীপুর কাছে শুনেছে এই কলঘরের পানি অনেক ঠান্ডা। জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। এই কথা মনে করে অহনা ফিক করে হেসে ফেললো। দীপুটা এ রকমই মাঝে মাঝে কঠিন শব্দ বলে, যেন অহনাকে তাক লাগিয়া দেয়া যায়। আকাশে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। তুলোর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঘেরা। অহনা যতো দেখছে, তত মুগ্ধ হচ্ছে। নীল রংটাকে যদি একপাশে সরিয়ে রাখা যায় আর সাদাটাকে অন্য পাশে। বেশ হতো, নীল সাদার দুই জায়গায় বাড়ি থাকতো। কলঘরের কাছে যেতেই দীপু কে দেখতে পেল। কলঘরের যে জায়গাটা পাকা করা তারপরে নিচের দিকে ড্রেন লাইনটা মাটির রাস্তার দিকে চলে গেছে । দীপু সেখানে পা ডুবিয়ে বসে আছে। অহনা দীপুর পাশে বসলো। দীপু বললো, অহনা পানি কিন্তু প্রচুর ঠান্ডা। অহনা হাত মুখ ধুয়ে নিল। দীপু, জামাকাপড় নিয়ে এলে বেশ হতো এখানে গোসল করতে পারতাম। দীপু জায়গাটা তো চমৎকার, সারাদিন বসে থাকা যাবে। অহনা পানির ঝাপটা চোখে মুখে দিয়ে ভাবছে, পৃথিবীটা তো অনেক বড়। এতোদিন ভাবতো স্কুলের মাঠ, সামনের নদী, পাশের গ্রাম ইত্যাদি। এই যে আলো মেঘের লুকোচুরি খেলা, মেঘগুলো উড়ে উড়ে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। দেখতে দেখতে আকাশটা সোনালি হয়ে এলো। যেন কাচাঁ হলুদ রং কেউ ছিটিয়ে দিয়েছে আকাশের বুকে। দীপু দেখ চারপাশটা কেমন সুন্দর লাগছে। এ রকম বিকেলের কথা অহনার অনেক দিন মনে থাকবে। বাসা থেকে না বলে চলে আসা, আকাশের বুক চিরে নতুন আলোর রূপ অহনার কাছে এক রহস্যময় পৃথিবীর জট খুলে যাচ্ছে। দীপু বিজ্ঞ লোকের মতো বললো, জানিস এ গোধূলি বেলায় যাদের বন্ধু তো হয় সারাজীবন থাকে। তাহলে আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম। দীপু তাড়াতাড়ি পা চালা পারাপারের নৌকা বন্ধ হয়ে যাবে। দুই ক্ষুদে কিশোর, কিশোরী প্রকৃতিকে নতুন আবিষ্কারের আনন্দ  পেছনে রেখে ছুটে যাচ্ছে নদী পারাপারের শেষ নৌকাটি ধরার জন্য।
———
শাইলা পারভীন সুমা

শায়লা
শাইলা পারভীন সুমা

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!