একটি ছোটগল্প আর থ্যালাসেমিয়া

ডাঃ দানিশ আরেফীন বিশ্বাস ।।

ফাহমিদা আহমেদ আর আলী রাজ্জাক। দুজন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। মাস্টার্স পাস করে বেরিয়ে আলী সম্প্রতি একটা ভাল চাকরি পেয়েছে। ব্যক্তি পছন্দের বিষয় থাকলেও ওরা দুইজন পারিবারিক ভাবেই বিয়ে-শাদী করতে আগ্রহী। দুই পক্ষের কথাবার্তা প্রায় শেষের দিকে, এখন বাকি শুধু বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত করা। ঠিক এমন এক সময় ফাহমিদার চোখ আটকে গেল একটি সিএনজির পেছনের লেখাতে, “থ্যালাসেমিয়া থেকে চাইলে রক্ষা, বিয়ের আগে করুন রক্ত পরীক্ষা।“

ফাহমিদা তার বাবাকে জানালো সে তার এবং আলীর দুজনের রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে চায় যে তাদের কেউ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কিনা? যদিও আলীর মা প্রথমে এটা করাতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি বলেই বসলেন, “আমাদের যুগে তো কখনো এমন কথা শুনিনি যে বিয়ের আগে জামাই বৌ এর রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। এ আবার কেমন মেয়ে?” কিন্তু আলী সাহেবের বাবা বিষয়টা নিয়ে একদিন তাঁর এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে কথা বললেন। ডাক্তার বন্ধুটি তাঁকে সংক্ষেপে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন। ফাহমিদা আহমেদ আর আলী রাজ্জাক দুজনে দুটি পৃথক সেন্টার থেকে রক্ত পরীক্ষা করালেন।

রিপোর্ট আসলো- ফাহমিদা আর রাজ্জাক উভয়ই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। আলীর বাবার ডাক্তার বন্ধুটি রিপোর্ট দেখে তাদের বিয়ের বিপক্ষে মত দিলেন। কারণ তাদের মিলনের ফলে যে শিশু পৃথিবীতে আসতে পারে, তাদের মারণ রোগ থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তারা এমন কাউকে নির্ভয়ে বিয়ে করতে পারবেন যারা এই রোগের বাহক নয়। সাময়িক ভাবে মনঃকষ্ট পেলেও ফাহমিদা আর রাজ্জাকের পরিবার এই বিয়ের প্রস্তাবনা ফিরিয়ে নিলেন। সম্ভাব্য থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত রোগীর জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হলো।

–এটা একটা গল্প মাত্র। কিন্তু এই গল্পের বিষয়গুলো বাস্তবে হওয়াটাও এখন সময়ের দাবি। আমরা এখন জানবো এই কাহিনীর পেছনের বেদনাদায়ক বাস্তবতা কি? কেনই বা আজ এত মানুষের রক্ত প্রয়োজন বেঁচে থাকার জন্য।

থ্যালাসেমিয়া কি?
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত বা জেনেটিক রোগ। এটি একটি ঘাতক রোগ। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে লোহিত রক্তকণিকা ঠিকমত তৈরি হতে পারে না। এর ফলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা আশংকাজনকভাবে কমে যায়। অন্য মানুষের দান করা রক্তই হচ্ছে এই রোগীর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। রোগীকে অবস্থাভেদে প্রতিমাসে ১ থেকে ২ ব্যাগ বা তারচেয়েও বেশি রক্ত নিতে হয়। সত্যিকার অর্থে থ্যালাসেমিয়া রোগের স্থায়ী চিকিৎসা নেই। থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত অধিকাংশ শিশুর শরীরে রক্ত না দিলে ৫ বছরের কম বয়সে মারা যায়। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের গড় আয়ু প্রায় ৩০ বছর। উন্নত দেশসমূহে ৫০ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে এই রোগের এক নীরব মহামারী চলছে। ধারণা করা হয়ে থাকে যে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি নারী-পুরুষ নিজের অজান্তে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৮ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মায়। এদের অনেকেই ৫ম জন্মদিন পালনের আগেই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ মানুষ এই রোগটি সম্পর্কে এখনো অবগত নন, এটা সবচেয়ে চিন্তার বিষয়।

এই রোগ কয় প্রকার?
সাধারণত থ্যালাসেমিয়া রোগ আলফা ও বিটা থ্যালাসেমিয়া- এই দুই ভাগে বিভক্ত। বিটা থ্যালাসেমিয়া আবার বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর এবং মাইনর এই দুই ভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে বিটা-থ্যালাসেমিয়া বেল্টে অবস্থিত। তাই এখানে বিটা থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।

বিটা থ্যালাসেমিয়া : বিটা থ্যালাসেমিয়া শিকল (Chain) গঠিত হয় দুইটি জিন দিয়ে। বাবা-মা থেকে প্রাপ্ত চারটি জিনের মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে বিটা থ্যালাসেমিয়া হয় এক্ষেত্রে :
১) একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যায়। এই অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Beta-thalassemia minor) অথবা বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট (Beta-thalassemia trait). এরাই মূলতঃ রোগটির বাহক।
২) দুটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। এ অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর ( Beta-thalassemia major)। নবজাতক যেসব শিশুর এই সমস্যা থাকে তারা জন্মের সময় বেশ স্বাস্থ্যবান থাকে। তবে জন্মের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা যায়। এরাই এই রোগের প্রধান ভুক্তভোগী।

রোগের বাহক কাকে বলে?
“কোন ব্যক্তি কোন রোগের বাহক” এই কথার অর্থ হচ্ছে, ওই ব্যক্তির মাঝে উক্ত রোগটি অন্য কোন ব্যক্তির মাঝে সরাসরি সংক্রমণ অথবা তাঁর ঔরসজাত বা গর্ভজাত সন্তানের মাঝে প্রেরণ করার সম্ভাবনা রাখেন। বাবা অথবা মা অথবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। এক্ষেত্রে একজোড়া বাহক দম্পতি নিজেরা সুস্থ থাকলেও তাদের মিলনের ফলে অসুস্থ শিশু জন্মগ্রহণ করার সম্ভাবনা থাকে। এই সম্ভাবনা ২৫% পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি, একজোড়া বাহক দম্পতির সকল সন্তান রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

থ্যালাসেমিয়ার বাহক কারা?
মানব দেহে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করতে দু’টি জিন (Gene) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি কোনো ব্যক্তির শরীরে এই দুইটি জিনের একটি জিন ত্রুটিযুক্ত হয় তবে তাকে কেরিয়ার (Carriar) বা বাহক বলা হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহকরা থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রকাশ হতে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে। তাই তাদের এ বিষয়ক কোন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। একটি নির্দিষ্ট রক্ত পরীক্ষা (হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস টেস্ট Hemoglobin Electrophoresis) ছাড়া আপনি বাহক কিনা তা জানার অন্য কোনো উপায় নেই।

থ্যালাসেমিয়া কিভাবে হয়?
থ্যালাসেমিয়া “বাহক” আর থ্যালাসেমিয়া “রুগী” একই কথা নয়। থ্যালাসেমিয়ার একজন বাহক অন্য আরেক বাহকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তাদের সন্তানের মাঝে থ্যালাসেমিয়া রোগ দেখা দিতে পারে। ২৫% সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগী, ৫০% থ্যালাসেমিয়া বাহক ও বাকি ২৫% স্বাভাবিক শিশু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্বামী-স্ত্রীর ব্লাড গ্রুপের মিল বা অমিলের সাথে থ্যালাসেমিয়া রোগের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। এতে আপনার অনাগত সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হবার ঝুঁকি এড়ানো যায়। দুইজন বাহকের মধ্যে বিবাহের মাধ্যম ব্যতীত থ্যালাসেমিয়া হওয়ার কোন পথ নেই। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর সাথে ওঠা-বসা করলে বা একই থালা গ্লাসে খেলেও থ্যালাসেমিয়া হয় না। এটি একটি জন্মগত রোগ, তাই অন্য কোন রোগের কারণে এই রোগের উৎপত্তি হয় না।

থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনসমূহ কি?
শিশু জন্মের কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর বয়সের মধ্যে এই রোগটির লক্ষণ প্রকাশ পায়। মানুষের শরীরে লোহিত রক্ত কণিকা অনবরত তৈরি হচ্ছে ও ১২০ দিন আয়ু শেষে প্লীহা তাদেরকে ছেকে বের করে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায় এবং অস্থিমজ্জার পক্ষে একই হারে লোহিত কণিকা তৈরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই রোগের উল্লেখযোগ্য লক্ষণগুলো হচ্ছে- ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, প্রচণ্ড দুর্বলতা, বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, জন্ডিস, ঘন ঘন বিভিন্ন ইনফেকশন হওয়া ইত্যাদি। শিশুর বৃদ্ধি হবে ধীরগতিতে অর্থাৎ তার হাঁটা, দাঁড়ানো বা বসা সবকিছুই অন্য বাচ্চাদের তুলনায় অনেক ধীরে ধীরে হবে।

একদিকে যেমন রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে প্লীহা আয়তনে বড় হতে থাকে, এর পর আস্তে আস্তে লিভার বড় হয়। রোগী ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করে, সাথে ক্ষুধামান্দ্য উল্লেখযোগ্য। এ সময় রোগীর শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য তার শরীরে রক্ত দেয়া শুরু হয়। নিয়মিত রক্ত না দিলে শিশুটি স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে না। আমাদের শরীর দৈনিক মাত্র ১ (এক) মিলিগ্রাম আয়রণ পরিত্যাগ করতে পারে। কিন্ত এক ইউনিট রক্তে প্রায় ২০০-২৫০ মিলিগ্রাম আয়রণ থাকে যা নিষ্কাশন করা শরীরের ক্ষমতার বাইরে। ফলে ধীরে ধীরে শরীরে অতিরিক্ত আয়রণ জমতে থাকে। এই অতিরিক্ত আয়রন জমা হয়ে হার্ট, প্যানক্রিয়াস, লিভারথাইরয়েড, পিটুইটারি, আড্রেনাল গ্লান্ড, টেস্টিস, ওভারি ইত্যাদি অঙ্গের কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। বার বার রক্ত সঞ্চালনের কারণে থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের রক্তবাহিত বিভিন্ন রোগ যেমন- হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, ম্যালেরিয়া, এইডস ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। অস্থিমজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় এবং এতে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া রোগের প্রভাব কি?
রোগীটিকে ঠিকমত ম্যানেজমেন্ট না করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া রোগি শীঘ্রই মারা যায়। আক্রান্ত রোগীর পরিবারের সদস্যরাও মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হন। এই রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা অত্যন্ত কঠিন। এসব রোগীর ৩০ বছর আয়ুস্কালে চিকিৎসার ব্যয় গড়ে মাথাপিছু ১২-১৫ লাখ বা তার চেয়েও বেশি টাকা। শরীরে জমতে থাকা আয়রণ দূর করার জন্য আয়রণ চিলেশন (Iron Chelation Therapy) নামক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়, এটিও বেশ কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল।

সহজভাবে বললে, একটি থ্যালাসেমিয়া রোগী নিজে কষ্ট পায় সবচেয়ে বেশি, পাশাপাশি তার পরিবারকে অর্থনৈতিক ভাবে নিঃস্ব করে ফেলে। অবশই এর সূদূরপ্রসারী নেতিবাচক পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাব রয়েছে।

থ্যালাসেমিয়া রোগ থেকে প্রজন্মকে বাঁচাবার উপায় কি?
এই রোগটি সাধারণত নিরাময় হয় না। থ্যালাসেমিয়া রোগীকে নিয়মিত রক্ত দিলেও অনেক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। যার ফলে স্বাভাবিক জীবন-যাপন ব্যাহত হয়। Hematopoietic stem cell transplantation (HSCT) বা সহজ কথায় স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশনের মাধ্যমে স্থায়ী চিকিৎসার চেষ্টা করা যেতে পারে। তবে তার খরচ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে এবং একজন সঠিক ডোনার পাওয়া কষ্টসাধ্য। জেনেটিক চিকিৎসার কিছু চেষ্টা চলছে, তবে তাও এখনো সুতিকাগারে।

তবে এই রোগটি সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। এজন্য নিজে বাহক কিনা তা রক্ত টেস্ট করে সবার আগে জানতে হবে। নিজে বাহক প্রমাণিত হলে বিয়ের আগে জেনে নিন আপনার হবু স্বামী বা স্ত্রী বাহক কিনা। একজন বাহক অন্য বাহকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হলে অতি সহজেই আপনার সন্তানের থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা যাবে। থ্যালাসেমিয়া শনাক্তকরণের রক্ত টেস্ট তেমন ব্যয়বহুলও নয় এবং প্রায় সারা দেশেই উচ্চতর মেডিকেল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবস্থা রয়েছে।

মেডিটেরিনিয়ান অঞ্চলভুক্ত দেশগুলো, বিশেষতঃ সাইপ্রাসে একসময় প্রচুর থ্যালাসেমিয়া রুগী থাকলেও বর্তমানে তা শূন্যের কোটায়। এটা সম্ভব হয়েছে বাহক বাহক বিবাহ কঠোরভাবে বন্ধ হওয়ার মাধ্যমে।

আপনি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কিনা তা জানার জন্য যা করবেন
রক্তের বিশেষ ধরনের পরীক্ষা হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস দিয়ে আমরা এই রোগের বাহক এবং রোগী নির্ণয় করতে পারি।

যেসব দম্পতি বাহক পরীক্ষা না করিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন কিংবা উভয়েই বাহক হওয়ার পরও সন্তান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের স্ত্রী গর্ভবতী হলে তারা গর্ভস্থ সন্তানের থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা তা জানার জন্য নিচের পরীক্ষাগুলো করতে পারেন।
• কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং (Chorionic villus sampling)
• অ্যামনিওসেনটিসিস (Amniocentesis)

এক্ষেত্রে স্ত্রী কনসিভ করার পর দেখে নিতে হবে সন্তানের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা? অ্যামনিয়োসে‌ন্থেসিস বা কর্ডোসে‌ন্থেসিস (সন্তান ধারণের ১৫ সপ্তাহের পর এই টেস্টগুলো করা যেতে পারে)। এছাড়া আছে সিভিএস টেস্ট। সন্তানের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে যে কোনো একটি করালেই ধরা পড়ে।

প্রতিক্ষেত্রেই আল্ট্রাসাউন্ড গাইডেন্সে ফ্লুইড নিয়ে সন্তানের ডিএনএ টেস্ট করে প্রকৃত চিত্র নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত সবচেয়ে ভাল কার্যকর পদ্ধতি সিভিএস, তবে চিকিৎসকরাই সঠিকতম পরীক্ষাটি ঠিক করে দিবেন। এক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার মাত্র ১০-১১ সপ্তাহের মধ্যেই টেস্ট করে নির্ধারণ করা সম্ভব।

তবে উপরোক্ত প্রতিটি পদ্ধতি যথেষ্ট জটিল এবং গর্ভস্থ শিশুর কিছুটা হলেও ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই সুস্থ সন্তান চাইলে বিয়ের আগে বাহক (ক্যারিয়ার) টেস্ট করা জরুরি।

প্রতিরোধের উপায় কি?
• দেশের সকল নাগরিককে এই রোগটি সম্বন্ধে সচেতন করে তুলতে হবে ও ন্যূনতম জ্ঞানদান করতে হবে যেন সামাজিক ও পারিবারিক সকল পর্যায়ে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ও ফলাফল সম্পর্কে মানুষের জানা থাকে।
• যদি পরিবারের যে কোনো সদস্যের (স্বামী ও স্ত্রী উভয় অংশের) থ্যালাসেমিয়া রোগের ইতিহাস থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই সকল শিশুর ক্ষেত্রে জরুরিভাবে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। বিবাহ এবং গর্ভধারণ করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া।
• থ্যালাসেমিয়া থেকে বাঁচতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, এ রোগের বাহকদের শনাক্ত করা। এজন্য ব্যক্তি বা জেলা বা জাতীয় কর্মসূচির মাধ্যমে, যেমন- স্ক্রিনিং কর্মসূচি গ্রহণ করে বাহকদের চিহ্নিত করে সঠিকতম পরামর্শ দিতে হবে। দুজন বাহক যদি একে অন্যকে বিয়ে না করে তাহলে কোনো শিশুরই থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করা সম্ভব নয়। অতএব, এসব ক্ষেত্রে আবেগের চেয়ে বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
• প্রতিরোধের অন্য উপায় হচ্ছে থ্যালাসেমিয়ার জিন বহনকারী কোন নারী গর্ভধারণ করলে তার সন্তান প্রসবের আগে অথবা গর্ভাবস্থায় ৮ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে প্রি-নেটাল থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় পরীক্ষা করিয়ে নেয়া। এ পরীক্ষার ফলাফলে যদি দেখা যায়, অনাগত সন্তান থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগে আক্রান্ত হয়েছে- তবে সে ক্ষেত্রে অনাগত সন্তানটির সম্ভাব্য মারাত্মক পরিণতির কথা ভেবে থেরাপিউটিক গর্ভপাত করার প্রয়োজন পড়তে পারে।

প্রয়োজনীয় উপদেশ ও করণীয় জানার জন্য কোথায় যোগাযোগ করবেন :
১) ঢাকা শিশু হাসপাতাল থ্যালাসেমিয়া সেন্টার।
২) হেমাটোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ, শাহবাগ, ঢাকা এবং সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসমূহ।
৩) ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বিএসএমএমইউ, শাহবাগ, ঢাকা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসমূহ।
৪) বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি।
৫) বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন।
৬) থ্যালাসেমিয়া সংক্রান্ত অনান্য হাসপাতাল / সমিতিসমূহ।
৭) যে কোন বিএমডিসির রেজিস্টার্ড মেডিকেল প্র্যাকটিশনার চিকিৎসক।

“রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়।” এই মূল নীতিকে সামনে রেখেই বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ ও স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক গবেষকবৃন্দ সরকার যন্ত্রের সাথে একত্রিত হয়ে শীঘ্রই থ্যালাসেমিয়া রোগটিকে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে নির্মূল করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। রোগ প্রতিরোধের জন্য রোগ সংক্রান্ত জ্ঞানের প্রয়োজন অপরিসীম। আমার এই লেখাটি একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র। আসুন আমরা একযোগে থ্যালাসেমিয়া নির্মূলে কাজ করি।

“বাহক টেস্ট করে সবাই বিয়ে-শাদী করুক, থ্যালাসেমিয়ার হাত থেকে বাচ্চারা বাঁচুক।”

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক (ট্রান্সফিউশন মেডিসিন), স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

Similar Posts

error: Content is protected !!