মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সড়ক নির্মাণে যত অনিয়ম!

খাইরুল মোমেন স্বপন, বিশেষ প্রতিনিধি ।।

শুরু থেকেই নানা অনিয়মে প্রশ্নবিদ্ধ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) এক প্যাকেজে সর্ববৃহৎ বাজেটে নির্মিত কিশোরগঞ্জের নিকলী-করিমগঞ্জ সংযোগের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সড়কটি। প্রায় সমাপ্তির পথে ২৪ ব্যক্তির দায়ের করা মামলায় স্থগিতাদেশ জারি করেছে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ।

জানা যায়, এলজিইডির ইতিহাসে এক প্যাকেজে সর্ববৃহৎ বাজেটের নিকলী-করিমগঞ্জ সংযোগের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সড়ক। দৈর্ঘ্যে ১০ দশমিক ৪৬ কিলোমিটার। সড়কটির নির্মাণ ব্যয় ৮০ কোটি ৫০ লক্ষ ৪১ হাজার ৩৮৪ টাকা। ভাঙ্গন কবলিত হাওর উপজেলা নিকলী। এর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত স্রোতোস্বিনী ঘোড়াউত্রা ও ধনু নদী। উপজেলাটির ৭ ইউনিয়নের সিংপুর, ছাতিরচর ও নিকলী সদর এই দুই নদীর অবিরত ভাঙ্গনে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার। উপজেলায় কোনো বালু মহাল নেই। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের সাথে আঁতাত করে এই দুই নদীর মিলিয়ন মিলিয়ন ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হয়েছে। সুদীর্ঘ সড়কটির উঁচুকরণে ব্যবহার করা হয়েছে এই বালু। সকল প্রকার মানবিকতা ও আইনি নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমবিইএল-এমএইচ (জেভি) কর্তৃপক্ষ।

ব্যয়বহুল সড়কটির ভিত্তি মজবুতে যে পরিমাণ বল প্রয়োগের প্রয়োজন এমন কোনো যন্ত্রই ব্যবহার করা হয়েছে বলে কোন সাক্ষী পাওয়া যায়নি। মাটিকাটার এস্কাভেটর দিয়েই সড়কের ঢাল সমান করা হয়েছে বলেই স্থানীয়দের দাবি। কোনো রকম পানি ছিটিয়ে কার্পেটের উপর ব্লক দেয়া হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতে নির্মাণ অবস্থায়ই স্থানে স্থানে ধ্বস দেখা দিচ্ছে। ব্লক তৈরির ইট-পাথরের যোগ্যতা নিয়েও অনেকের অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় দালাল চক্রের সাথে মিলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সড়কের অনুমোদিত নকশাও পরিবর্তন করা হয়েছে। সুবিধা গ্রহিতাদের নিকট থেকে মোটা অংক হাতিয়ে এমন কাজ করেছে বলে কিশোরগঞ্জ এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী বরাবরে একাধিক ব্যক্তির লিখিত অভিযোগ রয়েছে।

সড়কে ব্যবহার উদ্দেশ্যে দুই পাশের ৫ ফুট করে ১০ ফুটের মধ্যে ব্লক রাখা যেতো। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিন্যস্ত করার শ্রমিক খরচ কমাতে প্রতি পাশে ৫০ থেকে ১শ’ ফুটের অধিক প্রস্থের জমিতে ব্লকগুলি ছড়িয়ে রাখে। এতে প্রায় ৫শ’ একর জমিতে ৩ বছর যাবৎ চাষাবাদ করতে পারেনি কৃষকরা। ব্লক রাখতে জমির মালিকদের অনুমতিও নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। ক্ষতিপূরণে কয়েক দফা কৃষক নেতারা প্রতিষ্ঠান ও নিকলী এলজিইডির কাছে দাবি জানান। উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহমান মুহীন উর্ধ্বতনের সাথে আলোচনার আশ্বাস দেন। ৩ বছরেও কোনো প্রতিকার মিলেনি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি পেশ করে উল্টো হুমকির শিকার হয়েছেন। এমবিইএল-এমএইচ(জেভি)র কর্ণধার সেলিম মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দোহাই দিয়ে থাকেন। সবই কৃষকপক্ষের অভিযোগ। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এই উপজেলার (পরবর্তীতে মিটামইন ইউনিয়ন উপজেলায় পরিণত) সন্তান হওয়ায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশে নীরব ভূমিকা পালন করেছেন ভুক্তভোগিরা।

কারপাশা-নানশ্রী গ্রাম অংশে সড়কের মাঝে ৯টি পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি রেখেই করা হয়েছে পিচঢালাই। যানবাহন চলাচলে নিত্য দুর্ঘটনার কারণ এই খুঁটিগুলি।

সড়কটির নিকলী অংশের প্রায় ১০ কিলোমিটারের কাজ শেষ হওয়ার পথে। করিমগঞ্জের খয়রত এলাকায় একটি সেতু নির্মাণ শুরু হলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ স্থগিতাদেশ জারি করেন। সড়কের মাঝে স্থাপিত হয় স্থগিতাদেশে সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড। এতে দেখা যায়, ৫২১১/২০১৯, ২৩-০৫-১৯ খ্রিঃ তারিখে বিচারপতি মইনুল ইসলাম ও আশরাফ কামাল বেঞ্চ সড়ক নির্মাণে স্থিতাবস্থার আদেশ জারি করেছেন। উল্লেখিত জমির ওপর এলজিইডির আর কোনো নির্মাণ কাজ করা হলে ফৌজদারি অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

নিকলী উপজেলা প্রকৌশলী আবদুর রহমান মুহীন জানান, গত ১৮ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট হতে একটি উকিল নোটিশ পাই। করিমগঞ্জ উপজেলার খয়রত গ্রামের হাজি আহাম্মদ আলীর স্ত্রী হালিমা আক্তার, পুত্র মুজিবুর রহমান, জহির মিয়া, সোহেল মিয়া, মো. আলম এবং মদন গ্রামের মৃত সাহেব আলীর পুত্র আ. হামিদ গংসহ ২৪ ব্যক্তি বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। আমি সাথে সাথে জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফ খান সাহেবকে অবহিত করি। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এক আদেশে করিমগঞ্জ অংশের দুই কিলোমিটার সড়কের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে।

ফাইল ফটো

করিমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, মামলার কোনো কাগজপত্র পাইনি। সোজা করতে যেয়ে কিছু ব্যক্তির জমি সড়কটিতে পড়েছে। উর্ধ্বতনের সাথে আলোচনা চলছে। আশা করি শীঘ্রই সমাধান শেষে সড়কের কাজ শুরু হবে।

সড়ক প্রকল্প অনুমোদনে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য এলজিআরডির সাবেক সচিব কারার মাহমুদুল হাসান বলেন, কাজ বন্ধের ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের সকল পর্যায়ে কথা বলেছি। এলাকাবাসীর শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।

খয়রত ও মদন গ্রামের ভুক্তভোগি জমি মালিকরা জানান, অনেকেই মাত্র ২০-৭০ শতাংশ জমির উপর নির্ভরশীল। এই জমি সড়কে নিয়ে গেলে নিঃস্ব হয়ে যাবো। তাই ক্ষতিপূরণে সরকারের সদয় দৃষ্টি কামনা করি।

এমবিইএল-এমএইচ(জেভি)র কর্নধার সেলিম সকল অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, প্রতিবন্ধকতার কারণে কাজের ক্ষতি হচ্ছে। বৃষ্টিতে মাটি ভেঙ্গে যাচ্ছে। সিমেন্ট নষ্ট হচ্ছে। মোটা টাকার রড চুরি হচ্ছে। কাজে আগ্রহ হারাচ্ছি। মালামাল সরিয়ে নিয়ে যাবো। এতদিনে সড়কের কাজ শেষ করে এলজিইডির কাছে হস্তান্তর করতে পারতাম বলে তিনি আক্ষেপ করেন।

ফাইল ফটো

Similar Posts

error: Content is protected !!