বোরো ধানে সার ও পরিচর্যা

খোন্দকার মেসবাহুল ইসলাম ।।
বোরো ধানের বীজতলা থেকে শুরু করে রোপণ পর্যন্ত একটা বৈরি পরিবেশের মধ্য দিয়ে যায় বলে বিশেষ কিছু পরিচর্যা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। না হলে বোরোর ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। অন্যদিকে জমিতে ফলন ঠিক রাখার জন্য ধান চাষের আগে-পরে বা পাশাপাশি অন্য জাতের ফসলও চাষ করতে হয়। এতে ধান রোপণের আগে বা কাটার পর মধ্যবর্তী সময়ে স্বল্প সময়ের জন্য একটি ফসল চাষ করলে জমির উর্বরতা রক্ষা করা যায়। বোরো চাষের আগে যদি আলু, সরিষা বা শিম জাতীয় শস্য চাষ করে নেয়া যায় এবং বোরো চাষের পর ধৈঞ্চার চাষ করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া যায়, তাহলে জমির স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যায়। কারণ এসব ফসলে সার প্রয়োগ যথাযথভাবে করা হয় ভালো ফলনের জন্য। যা পরবর্তী বোরোর জন্যও কাজে লাগে।
জমিতে জৈব পদার্থ যোগ হয়ে জমির উর্বরতা রক্ষা পায়, জমিতে প্রয়োগ করা রাসায়নিক সারের গ্রহণ যথাযথ হয় এবং রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে জমিতে তৈরি হওয়া বিষাক্ততা কমে যায়। এ জন্য বোরো-রোপা আমন শস্য বিন্যাসে যেসব ফসল ব্যবহারের বা চাষের সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো চাষের ব্যবস্থা নিলে বোরোর উচ্চ ফলন পাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত হয়। এসব শস্য বিন্যাস অনুসরণ করলে প্রচলিত শস্যবিন্যাসের চেয়ে প্রতি এককে শতকরা ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ বেশি ফলন পাওয়া যেতে পারে।
সেচ সুবিধাপ্রাপ্ত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমির জন্য বোরো চাষের বিভিন্ন শস্য বিন্যাসের সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১. বোরো (বিআর ২৬)-রোপা আমন (ব্রিধান ৩২) -সরিষা (টরি-৭); ২. বোরো (বিআর-২৬)-রোপা আমন (ব্রিধান ৩২) -সবুজ সার (শনপাট); ৩. বোরো (ব্রিধান ২৮)-গিমাকলমি-রোপা আমন (ব্রিধান ৩২); ৪. বোরো (বিআর ৩)-পতিত-রোপা আমন (বিআর ১১); ৫. বোরো (বিআর ২৬)-রোপা আমন (ব্রিধান ৩২)-সবজি (মটরশুঁটি / ঝাড়শিম); ৬. অঙ্কুরিত বোনা বোরো (ব্রিধান ২৮)-সবুজ সার-রোপা আমন (বিআর ১১)
বোরোর জমিতে নিয়মিত জৈবসারের বা সবুজ সারের ব্যবস্থা করতে না পারলে যথেষ্ট জৈবসার নিয়মিত প্রয়োগ করতে হয়। আলু বা রবি শস্য চাষের সময় রাসায়নিক সারের সাথে যে জৈবসার ব্যবহার করা হয় অনেকে সেটাকেই যথেষ্ট মনে করেন বোরো চাষের সময়েও। অর্থাৎ বোরোতে জৈবসার কম ব্যবহার করেন। বোরোর জমিতে সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক সারের সাথে জৈবসার ব্যবহার করলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া সম্ভব।
রবি ফসলে ব্যবহৃত পটাশ, ফসফেট, জিপসাম ও দস্তা সারের প্রভাব পরবর্তী ফসল পর্যন্ত কার্যকর থাকে বলে বোরো চাষে এসব সার অর্ধেক মাত্রায় বা আগের ফসলে ব্যবহৃত পরিমাণের উপর ভিত্তি করে প্রয়োগ করতে হয়। তবে ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা যেহেতু মাটিতে স্বল্প সময় বিদ্যমান থাকে, তাই এই সার আগের ফসলে পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করলেও বোরো চাষের সময়েও মাত্রানুযায়ী ব্যবহার করতে হয়।
পটাশ সারের উপাদান পটাশিয়াম বিভিন্ন ফসল (আলু ও সবজি) মাটি থেকে গড়ে হেক্টর প্রতি প্রায় ১২০-১৪০ কেজি পর্যন্ত গ্রহণ করে। ফসফেট সারের উপাদান ফসফরাস গ্রহণ করে ১৫ থেকে ২০ কেজি এবং গৌণ সার গন্ধক (জিপসাম) ৭ থেকে ১৫ কেজি ও দস্তা খুবই সামান্য গ্রহণ করে। অবশিষ্ট অংশ জমিতেই থেকে যায়, যা পরবর্তী ফসল হিসেবে বোরো ধান গাছের কাজে লাগে। আর সেজন্যই আগের ফসলে প্রয়োগকৃত এসব সারের পরিমাণ জেনে বোরোতে সার প্রয়োগ করতে হয়।
বোরো চাষে তিন বারে মোট ইউরিয়া সার সমানভাবে ভাগ করে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। প্রথমবার জমি তৈরির শেষ সময়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। দ্বিতীয়বারে অধিকাংশ ধান গাছের গোছায় ৪ থেকে ৫টি কুশি দেখা গেলে এবং শেষবারে কাউচথোড় হওয়া অবস্থার ৫ থেকে ৭ দিন আগেই দিতে হয়। ইউরিয়া প্রয়োগের সময় মাটিতে অবশ্যই প্রচুর রস থাকতে হয়। ২ থেকে ৩ সেন্টিমিটার পানি থাকা ভালো। ইউরিয়া প্রয়োগের পরপরই হাত দিয়ে বা উইডার দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কারের ব্যবস্থা নিলে একদিকে যেমন আগাছা নিড়ানোর কাজ করা হয় অন্যদিকে তেমনি প্রয়োগকৃত সার মাটিতে মিশে যায়। আগাছা পরিষ্কারের ফলে প্রয়োগকৃত ইউরিয়ার যথা সম্ভব বেশি পরিমাণে গাছ গ্রহণ করতে পারে। তবে মনে রাখতে হয় কোনো অবস্থাতেই ইউরিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার ধানের ফলন বাড়ায় না। এজন্য এলসিসি ব্যবহার বাড়িয়ে অর্থাৎ ধান গাছের পাতার সাথে রঙ মিলিয়ে সঠিক সময়ে ও সঠিক পরিমাণে ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়ার সাশ্রয় বা ব্যবহারে কার্যকারিতা বাড়াতে গুটি ইউরিয়া বোরোর ক্ষেতে ব্যবহার করা যায়। গুটি ইউরিয়ার সুফল পেতে সারি করে রোপণ করা ক্ষেতের কাদা মাটিতে প্রতি ৪টি গোছার মাঝে একটি করে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হয়।
ইউরিয়ার উপরি প্রয়োগের পরও যদি ধান গাছের নতুন পাতা হলুদাভ হতে থাকে এবং গাছের বাড়-বাড়তি ও কুশি সংখ্যা কমে যায়, তাহলে এটি গন্ধকের কারণে হয়েছে বলে ধরে নিতে হয় এবং দ্রুত পদপে হিসেবে জমির পানি সরিয়ে নিয়ে হেক্টর প্রতি ৬০ কেজি হারে জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করতে হয়। জিপসাম সার উপরি প্রয়োগের সময় শুকনো মাটি বা ছাইয়ের সাথে অথবা ইউরিয়া উপরি প্রয়োগের সময় একসাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যায়। অবস্থা বুঝে গন্ধক সার ব্যবহার না করলে ধানের শীষের সংখ্যা কম হয়, শীষে পুষ্ট ধানের সংখ্যা কম হয় এবং চিটার সংখ্যাও বেশি হয়। এতে ফলন মারাত্বকভাবে কমে যায়। গন্ধকের অভাব আক্রান্ত ক্ষেতের ধান পাকতে যেমন সময় বেশি লাগে তেমনি একই জমির ধান বিভিন্ন সময়ে পাকতে থাকে। এতে ধান কাটতে খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।
অনেক সময় বাড়ন্ত ধান গাছের কচি পাতার গোড়া সাদা হয়ে যায়। পরে অন্যান্য বয়সী পাতা হলুদাভ হয় এবং পাতার আগার দিকে বাদামি দাগ দেখা যায় ও পরে শুকিয়ে যায়। ধানের কুশির সংখ্যা কমে যায়। ধান ক্ষেতের কোথাও চারা বড় হয় আবার কোথাও চারা ছোট হয়। পাতার আকারও ছোট হয়। এই লণ দেখা গেলে ধরে নিতে হয় যে জমিতে দস্তার অভাব দেখা দিয়েছে। সেময়ে জমি থেকে পানি বের করে দিতে হয়। এরপর হেক্টর প্রতি ১০ কেজি হারে দস্তা সার উপরি প্রয়োগ করতে হয়। দস্তার সার অপচয়ের হাত থেকে রার একটি সহজ উপায় হচ্ছে, দু’বারে যথাক্রমে চারা রোপণের ১০ থেকে ১৫ দিন ও ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর প্রতি লিটার পরিস্কার পানিতে ৪.৫ থেকে ৫ গ্রাম দস্তা সার (জিঙ্ক সালফেট) মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়।
বোরো ক্ষেতের অন্যান্য পরিচর্যার মধ্যে অন্যতম হলো পানি সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থাপনা। চারা রোপণের পর জমিতে পানি এমনভাবে রাখতে হয় যেন চারা কোনো অবস্থাতেই ডুবে না যায়। আবার বোরো ধানের জমিতে সবসময়ই যে পানি ধরে রাখতে হয় তা কিন্তু নয়। একটি সেচের পর আরেকটি সেচ দেয়ার মধ্যবর্তী সময়ে তে যদি ৩ থেকে ৪ দিন শুকনো রাখা যায় তাহলে ধান গাছের বৃদ্ধি কমে না বরং পানির সাশ্রয় হয় মোট পানি খরচের ২৫ থেকে ৩০ ভাগ। যেসব এলাকায় গভীর নলকূপ দিয়ে সেচ দেয়া হয় সেসব এলাকার জমিতে এভাবে সেচ দিলে বর্তমানে যে পরিমাণ জমিতে পানি সেচ দেয়া যায়, তার চেয়েও প্রায় ৪০ ভাগ বেশি জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হতে পারে। এতে একদিকে যেমন পানির খরচ কমে অন্যদিকে তেমনি চাষের এলাকা বৃদ্ধি করাও সম্ভব। আবার বেশি পানি খরচ না করায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ারও আশঙ্কা কমে যায়। বোরো ক্ষেতে কাইচথোড় আসা পর্যন্ত এভাবে পানি সেচ দেয়া যায়। তবে কাইচথোড় অবস্থা শুরু হলে জমিতে ৫ থেকে ৭ সেন্টিমিটার গভীরতার পানি রাখা ভালো।
সার প্রয়োগর আগে জমি থেকে পানি কমিয়ে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। এর ২ থেকে ৩ দিন পর পুণরায় জমিতে পরিমিত পানি সেচ দিলে প্রয়োগকৃত সারের কার্যকারিতা বাড়ে। জমিতে পানি ধরে রেখে দানাদার বালাইনাশক ব্যবহার করলে এর কার্যকারিতাও বাড়ে। ধানের দানা গঠন থেকে শুরু করে ধান পাকার আগে দানা শক্ত হওয়ার সময় পর্যন্ত জমিতে পানি ধরে রাখলেই চলে। দানা শক্ত হতে শুরু করলেই জমি থেকে পানি সরিয়ে জমি ভেজা ভেজা অবস্থায় রাখতে হয়।
জমির আইল কেটে সাধারণত সেচ দেয়া হয়। এতে জমির মাটি ও পানির অপসারণ ও অপচয় হয়। এই অবস্থা রোধ করতে প্লাস্টিকের (ফিতা) বা পিভিসি পাইপ ব্যবহার করলে মাটির অপসারণ ও পানির অপচয় রোধ করার সাথে সাথে সেচের খরচও কমানো যায়। কারণ কাঁচা নালার তুলনায় এই ব্যবস্থায় শতকরা প্রায় ৪২ ভাগ বেশি জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হয়।

boro_rice
লেখক : কৃষিবিদ
সূত্র : নয়া দিগন্ত

Similar Posts

error: Content is protected !!