এ কী করলেন হাসান?

বিশেষ সংবাদদাতা, কিশোরগঞ্জ ।।
হাসান মিয়া। কিশোরগঞ্জ শহরে ভদ্র, বিনয়ী, লাজুক মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কথা বলতেন নিচুস্বরে, আচার-আচরণে সব সময় ছিল মার্জিতভাব। লোকজন তার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও তিনি নীরবে সয়ে যেতেন। নিজে কষ্ট পেলেও কারো মনে কষ্ট দিতেন না চাপা স্বভাবের হাসান। চাকরি করতেন কিশোরগঞ্জ জজ কোর্টে কম্পিউটার অপারেটর পদে।
শহরের প্রিয়মুখ এই হাসানের (২৯) ঝুলন্ত লাশ শুক্রবার সন্ধ্যায় তার ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। একটি মাফলার দিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে ছিলেন তিনি। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার হালিমপুর ইউনিয়নের জ্ঞানপুর গ্রামে। কিশোরগঞ্জ শহরের ফিশারি রোডের একটি তিনতলা বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থেকে দু-তিন বছর আগে পাওয়া চাকরিটা করতেন তিনি। অনার্স-মাস্টার্স করেছেন গুরুদয়াল সরকারি কলেজে।
হাসানের বড়ভাই তাজুল ইসলাম জানান, হাসানকে সাত মাসের কোলে রেখে মারা যান আমার মা। তখন আমার বয়স ছিল দেড় বছর। কিছুদিন পরই বাবা নূরুল ইসলাম আরেকটি বিয়ে করেন। কিন্তু সৎমা দু’ভাইকে সহজভাবে মেনে না নেয়ায় মামারা নিজেদের কাছে নিয়ে আসেন আমাদের। মা-বাবার আদর, ভালোবাসা ও স্নেহ কী জিনিস- তা পাইনি। তবে মামারা সাধ্যমতো আমাদের লালন-পালন ও পড়াশোনা করিয়েছেন। আমি নেত্রকোনায় ত্রাণ অফিসে অফিস সহায়ক পদে চাকরি করছি। হাসান ছিলো কিশোরগঞ্জ জজ কোর্টে।

hasan_kishoregong
আত্মহত্যার আগে একটি চিঠি লিখে যান হাসান। পুলিশ সেই চিঠিটি তার বাসা থেকে উদ্ধার করেছে। সেখানে তার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয় বলে লিখে গেছেন। তাছাড়া তিনি নিজের সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক কথা লিখে গেছেন। বলেছেন, ‘আমি কারো উপকারে লাগতে পারিনি। মানুষে আমাকে ভালো জানলেও প্রকৃতপক্ষে আমি খুব খারাপ মানুষ। এ ধরনের মানুষের এমন পরিণতিই হওয়া উচিত। দয়া করে আমার লাশ কবর না দিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখবেন।’
হাসানের এমন মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছেন না। হাসানের বন্ধু আলমগীর হোসেন বলেন, ওর মতো এত ভালো ছেলে খুব কমই দেখেছি আমি। সে চিঠিতে যা লিখে গেছে তা সত্য নয়। চাকরি পাওয়ার পর অভাব দূর হলেও, তার মনের অশান্তি দূর হয়নি। সেই না পাওয়ার বেদনা ও ক্ষোভ থেকেই সম্ভবত তার এই চিঠি এবং চলে যাওয়া।
জানা গেছে, বাবা-মার স্নেহ-ভালোবাসাবঞ্চিত হাসান একটি মেয়েকে ভালোবাসতেন। তবে কিছুদিন আগে সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়ায় হতাশ হন তিনি। এরপর হাসানের জীবন এলোমেলো হয়ে যায়।
হাসানের মামা শরীফ মিয়া জানান, এসব বিষয় তারা জানতেন না। তার মৃত্যুর পর শুনতে পাচ্ছেন। আসলে ও এতই চাপা স্বভাবের ছিল যে কোনো কিছুই কারো সঙ্গে শেয়ার করত না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা হাসানকে বড় করলেও আমরা তো আর বাবা-মার ভালোবাসা ও স্নেহ দিতে পারিনি। বাবা-মা’র শিক্ষা ও আদর-সোহাগ পেলে হয়ত তার জীবনটা অন্যরকম হতো। এমন দুর্ঘটনা ঘটত না।
দৈনিক সমকালের কিশোরগঞ্জ অফিসের স্টাফ রিপোর্টার সাইফুল হক মোল্লা দুলু বলেন, সরকারি চাকরি হওয়ার আগে আমার অফিসেই কাজ করত হাসান। বাইরে থেকে কখনো মনে হয়নি সে ভেতরে ভেতরে এতটা অশান্ত ও চরম স্বভাবের। আসলে স্নেহ-ভালোবাসা না পাওয়ারা এমন জেদি হয় বলেই শুনেছি। তবে তার মতো শিক্ষিত ও সম্ভাবনাময় ছেলের নিজের ওপর এভাবে অভিমান করা ঠিক হয়নি।
কিশোরগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোশারফ হোসেন বলেন, হাসানের মৃত্যুর ব্যাপারে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। আজ শনিবার ময়নাতদন্ত শেষে লাশ তার মামার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

Similar Posts

error: Content is protected !!