জামিউল হক ফয়সাল ।।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত/সমালোচিত বিষয় হচ্ছে শিশুর প্রতি সহিংসতা বা শিশু নির্যাতন। শিশুর প্রতি সহিংসতার খবর প্রতিনিয়তই নাড়া দিচ্ছে মানব বিবেককে। বর্তমান সময়ে শিশুরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত, সহিংসতার শিকার হচ্ছে। যেমন- ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, হত্যা, নিখোঁজের পর মৃতদেহ উদ্ধার, শিশু পাচার, নবজাতক চুরি, গৃহ শ্রমিকের উপর নির্যাতন, এসিড সন্ত্রাসের শিকার, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্নভাবে শিশুরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই ১৯৩ টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। (তথ্য সূত্র-বিএনডব্লিউএলএ)। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে ২০১৬ সালের শুধু জানুয়ারি মাসেই ২৯টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।
অথচ শিশুর সর্বোত্তম মঙ্গলের কথা মাথায় রেখে কালে কালে বিভিন্ন ধরনের আইন, সনদ বা চুক্তি, বিভিন্ন বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত শিশুর সুরক্ষা, সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা করতে এসেছে কঠোর আইন, বিধান ।
আন্তর্জাতিকভাবে শিশুর মঙ্গলের জন্য বিভিন্ন সময় বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ নিম্নে আলোচনা করা হল
*১৯৪৮- সালে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে “আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্র” অনুমোদন করে। যেখানে শিশুর অধিকারও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
* ১৯৫৩ সালে শিশু কল্যাণ ইউনিয়ন ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে “বিশ্ব শিশু দিবস পালিত হয়।
* ১৯৫৯ সালে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে শিশুদের অধিকারের জন্য দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র অনুমোদন করে।
*১৯৭৯ সালে – আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষ পালিত হয়।
শিশুদের অধিকারে বড় সাফল্যটি আসে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে “আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ” গৃহীত হয়। এতে বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে অনুসমর্থন করে। শিশু অধিকার সনদের মূল নীতি ছিল বৈষম্যহীনতা, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ, শিশুর বেঁচে থাকা ও বিকাশ, শিশুর অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা ।
এখানে আমার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদ ও চুক্তি নিয়ে আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হছে শিশুদের মঙ্গল, স্বার্থের কথা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট রাষ্ট্রই ভাবেননি,সারা বিশ্বও শিশুদের নিরাপদ রাখতে ভেবেছে।
আন্তজাতিক বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের কঠোর আইন, বিধান প্রনয়ন করেছেন। চলেন একনজরে দেখে নেই সেই আইন ও বিধি-বিধাগুলো-
(১) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ ( সংশোধিত -২০০৩)
(২) মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২
(৩) দণ্ডবিধি-১৮৬০
(৪) এসিড অপরাধ দমন আইন-২০০৪
(৫) পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রন আইন-২০১২
(৬)বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন -১৯২৯
(৭) পারিবারিক সহিংসতা ( প্রতিরোধ ও সুরক্ষা ) আইন-২০১০
(৮) শ্রম আইন-২০০৬ ।
এছাড়া ও শিশুদের সর্বোত্তম কল্যাণের জন্য “শিশু আইন-২০১৩” প্রণয়ন করা হয়েছে। তাছাড়া গনপ্রজাতন্ত্রি বাংলাদেশের সংবিধানেও শিশুদের বিশেষ অধিকার দিয়েছে। শিশুদের মঙ্গলের স্বার্থে উচ্চ আদালতেরও বিভিন্ন নির্দেশনা রয়েছে।
আসুন এইবার জেনে নেই, আইনে “শিশু” বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে?
২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী নবজাতক থেকে শুরু করে ১৮ বছরের কম বয়সী সব মানুষকে “শিশু” বলা হয়।
একনজরে জেনে নেই, কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিশু অপরাধের শাস্তি ;
শিশু ধর্ষণের শাস্তি; – নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শিশু ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ধর্ষণের ফলে মৃত্যু হলে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি রাখা হয়েছে।
যৌনপীড়ন/ শ্লীলতাহানীর শাস্তি- : কোনো ব্যক্তি যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশে নারি/শিশুর যৌনাঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করলে বা শ্লীলতাহানী করলে ৩ (তিন) থেকে ১০ (দশ) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
শিশু বা মানবপাচার করলে এর শাস্তি : কোনো ব্যক্তি মানবপাচারের মতো অপরাধসংগঠন করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশে অপহরণ করার শাস্তি কি : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশে আটক রাখলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা (১৪) চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।
এছাড়াও শিশুদের প্রতি অন্যান্য সহিংসতার ঘটনা ঘটলে, যেমন শিশু চুরি, ভিক্ষাবৃত্তি বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রির উদ্দেশে শিশুর অঙ্গহানি করা, শিশুকে পর্ণগ্রাফিতে ব্যবহার করা, পারিবারিক সহিংসতা, শিশু শ্রম, বাল্যবিবাহ, শিশুকে নেশাগ্রস্থ করা বা বিপদজনক ওষুধ প্রদান, শিশুকে যৌনবৃত্তিতে পরিচালনা করানো প্রভৃতি অপরাধজনক কাজের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তির বিধান।
তাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা শিশুবান্ধব আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সংস্লিষ্ঠ মহল ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করবেন।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও মানবাধিকার কর্মী
email-adv.jhfaisal@gmail.com