বহুমাত্রিক প্রতিভার খায়রুল আলম বাদল (ভিডিও)

সম্প্রতি টিভি চ্যানেল একুশে টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে নিকলীর বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই গুণী শিল্পীর জীবন সংগ্রামের কথা। জাতীয় একটি সংবাদপত্রও এই সাক্ষাৎকারটি ছেপেছেন বিশেষ গুরুত্বের সাথে। তিনি সবার প্রিয়মুখ খায়রুল আলম বাদল। সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

khairul_alam_badal

১৯৯২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে প্রচারিত ১৮ বছরের এক পঙ্গু কিশোরের ছবি আঁকা, চিত্রপ্রদর্শন, তার তৈরি ভাস্কর্য প্রদর্শন, অভিনয়, বংশীবাদন, পায়ের সাহায্য ছাড়া বিটিভি টাওয়ারে আরোহণ, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ধানমন্ডি লেক সাঁতরে পার হওয়ার মতো অবিশ্বাস্য সব ঘটনা অবাক চোখে প্রত্যক্ষ করেন কোটি দর্শক। বাদল নামের সে বিস্ময় প্রতিভার জন্ম কিশোরগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত নিকলী উপজেলার বড়হাটি গ্রামে। পোলিও সর্বনাশা ছোবলে শিশু বাদলের পা দুটি কেড়ে নিলেও তার পথচলাকে থামিয়ে দিতে পারেনি। অদম্য মনোবল নিয়ে বাদল নেমেছে হাওরের পানিতে। অনায়াসে ভেসে থেকেছে পানির ওপর, পার হয়ে গেছে পুকুর-নদী, পানিতে শুয়েই সুর তুলেছে তার প্রিয় বাঁশের বাঁশিতে, সেরে নিয়েছে নাস্তা। দুটি পা হারিয়ে শারীরিক পঙ্গুত্ব বরণ করার পরও মানসিক দৃঢ়তা, প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি ও একাগ্রতায় প্রতিভার নিরন্তর প্রকাশ ঘটিয়েছে বাদল। যার ছাপ পড়েছে তার অভিনয়, চিত্রকলা, লেখালেখি, শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চায়। আর এভাবেই স্বপ্নডিঙায় ভেসে ভেসে হাওরের বাতাসে অনবরত সুবাস ছড়িয়ে চলেছে বাদল। দৃঢ় মানসিক শক্তি আর নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে একজন প্রতিবন্ধীও যে সুস্থ প্রতিভাবান মানুষকে ডিঙাতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে খায়রুল আলম বাদল

নিজে গড়া সাংস্কৃতিক দলের সাথে ২০১১ সালে যখন মঞ্চে
নিজে গড়া সাংস্কৃতিক দলের সাথে ২০১১ সালে যখন মঞ্চে

পিতা মরহুম ডা. আবদুল আজিজ। জন্মের দুই বছর পর পোলিও রোগে আক্রান্ত হন। একদিনের জ্বরে পুরো শরীর অবশ হয়ে পড়ে, এমনকি কথা বলাও বন্ধ হয়ে যায়। অব্যাহত চিকিৎসা চলার পর দেড় বছরে আমার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ স্বাভাবিক হলেও চিরদিনের জন্য পা দুটি অচল হয়ে যায়। এরপর শুধু মানসিক শক্তির জোরে আজ এ পর্যন্ত এসেছেন তিনি। ছোটবেলায় যখন অন্যান্য বন্ধুরা স্কুলের মাঠে খেলা করতো, ছুটোছুটি করতো আমি তখন তিনি শুধু চেয়ে দেখতেন। তারা যখন সাঁতার কাটতো তখন দেখে খুব হিংসা হতো তার। বিশাল দেহের গরু যদি চিকন পা নিয়ে পানিতে ভাসতে পারে তবে সে কেন পারবে না, এখান থেকেই খুঁজে বের করলেন এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। শুরু হয় এগিয়ে যাওয়া। একাধারে চিত্রশিল্প, কারুশিল্প, অভিনয়, গান, আবৃত্তি, সাংবাদিকতা ও দ সংগঠক হিসেবে নিজেকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন তিনি

ইট-সিমেন্টে গড়া শিল্পকর্ম
ইট-সিমেন্টে গড়া শিল্পকর্ম

জীবিকার তাগিদেই মফস্বল শহরের একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র একটি পার্কের ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন। পার্কটি নতুন বিধায় তার মতো করে গুছিয়ে নেয়ার দায়িত্ব পেলেন তিনি। ভাস্কর্য এবং ভিন্নমাত্রার দেয়ালচিত্রে দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করা যাবে মনে শুরু করলেন দেয়ালে এম্বুস ভাস্কর্য দিয়ে। সেখান থেকেই শুরু।

নির্মাণ এবং শিল্প ভিন্ন দুটি বিষয়। নির্মাণ করা হলো নির্মাতাদের কাজ আর শিল্প হচ্ছে শিল্পীদের কাজ। নির্মাণের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য শিল্প অপরিহার্য একটি বিষয়। শিল্প হচ্ছে নির্মাণের বাহ্যিক রূপ। একজন নির্মাতা সেই রূপ সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু শিল্পী ইচ্ছা করলেই নির্মাণের কাজ সমাধা করতে পারে না। শিল্প হচ্ছে কোন কাঙ্খিত বিষয়ে শিল্পীর মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কাল্পনিক সৌন্দর্যের বাহ্যিক রূপ। এ পর্যন্ত অনেক গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে, তার সৃষ্টকর্ম নিয়ে অনেক সংবাদ, ফিচার প্রকাশিত হয়েছে। রোববার একুশে টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘জন্মের ২ বছর পরই আমি আমার চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। তবু থেমে থাকিনি। মানুষ তো আসলে চলে মাথা দিয়ে, পা দিয়ে নয়, আমার পা নেই কিন্তু মাথাটা বোধ হয় আল্লাহ সুস্থই রেখেছেন যার জন্য কোন প্রতিবন্ধকতাই আমার কাছে প্রতিবন্ধকতা মনে হয় না।’

shilpokormo1

ইট-সিমেন্টে গড়া শিল্পকর্ম
ইট-সিমেন্টে গড়া শিল্পকর্ম

এভাবেই বলছিলেন খায়রুল আলম বাদল। বর্তমানে পার্কে কর্মরত থেকেও তিনি থেমে নেই। চিন্তার দিগন্ত প্রসারিত করার ক্ষেত্রে আপোষহীন এই মানুষটি সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করতে চান। সে প্রচেষ্টায় নিরলস কাজও করে যাচ্ছেন। ছোটবেলা থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবেলা করে শিল্পকলার প্রতি অনুরক্ত বাদল এর শিল্পকলায় প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ছাড়াই একজন দক্ষ শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তার তৈরি মাটি ও মোমের ভাস্কর্য সবার নজর কাড়ে।

স্ত্রী নাজমা বেগম এবং ছেলে দিবস (১৩) ও মেয়ে দিবাকে (৬) নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। নিজে প্রতিবন্ধী বলেই হয়তো প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে সামনে থেকে লড়াই করতে চান তিনি। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করতে চায়, অনুকূল পরিবেশ পেলে একজন প্রতিবন্ধী মানুষও অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও মানসিক শক্তি দিয়ে বাস্তব জীবনের যে কোনো অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। প্রতিবন্ধীদের জন্য সত্যিকার অর্থে বাস্তব পদক্ষেপ নিলে তারা সমাজের বোঝা নয়; বরং রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত হতে পারে। তার স্বপ্নডিঙায় সওয়ার হয়ে প্রতিবন্ধীরা জয় করবে সাত সমুদ্র, এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি

লেখক : সারোয়ার আলম
সূত্র : আমাদের সময়, ইটিভি (ভিডিও)

Similar Posts

error: Content is protected !!