স্যারের ঋণ কখনোই শোধ হবার নয়

নাসির উদ্দিন মিয়া ।।

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। দেশে তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন চাঙ্গা। চারিদিকে স্লোগান “চলো চলো ঢাকা চলো, ক্যান্টনমেন্ট দখল করো”। এমনই এক দিন ২০ ফেব্রুয়ারি জানতে পারি, পাকিস্তানি আর্মির নির্দেশে স্থানীয় কতিপয় দোসর নিকলীর শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলবে। প্রবল ঝড়-তুফান মাথায় করে নিকলী এসে পৌছলাম। উদ্দেশ্য, আন্দোলনে সমমনা সবাই মিলে শহীদ মিনার ভাঙ্গা রোধ করা। সেই দলে আমিসহ দামপাড়ার ইদ্রিস, নিকলীর মির্জালি, মোহরকোনার আহমদ, পূর্বগ্রামের হাসেন আলী, নাম না-জানা আরো কয়েকজন ছিলো।

কোনো একটা মিটিং শেষে রাতে বাসায় ফেরার পথে হঠাৎই হেডমাস্টার স্যার (আব্দুল হামিদ স্যার) তাঁর বাড়ির সামনে আমাকে দেখে ফেললেন। জিজ্ঞেস করলেন, কিরে এত রাতে ঝড়ের মাঝে এখানে কি করিস? সহরমুল থেকে আসলি কিভাবে? তখন স্যারকে শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলার পরিকল্পনার কথা জানালাম। শুনে স্যার কেঁদে ফেললেন। আবেগজড়িত কণ্ঠে বললেন, তুই এখন বাড়িতে চলে যা। আর একটা কথা মনে রাখিস, তোরা তীব্র ঝড়-তুফানের মধ্যে এত দূর থেকে শহীদ মিনার ভাঙ্গা রোধ করতে আসছস। তোদের মাঝে দেশপ্রেম যে কী পরিমাণ আছে তা বোঝা গেছে। শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেললে তোদের মূল আন্দোলনের খুব একটা কিছু যাবে-আসবে না; তোরা ওইদিকটাতেই মন দে। এখন ফিরে যা, আমি এই দিকটা দেখছি।

স্যার কতটা দূরদর্শী ছিলেন এতে বোঝা যায়। তিনি আমাদের ছোট ক্ষতি ছেড়ে দিয়ে বড় অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে সেদিন সবাইকে নিজ নিজ বাড়িতে ফেরান।

ক্লাসরুমে শিক্ষাদান করেই ক্ষান্ত ছিলেন না “হেডমাস্টার” স্যার। বহু গুণে গুণান্বিত একজন আদর্শবান মানুষ ছিলেন তিনি। ইংরেজি, অংকসহ কঠিন বিষয়গুলো শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছাত্রদের জন্য পড়াশোনায় নিতেন বিশেষ উদ্যোগ। বাড়ি-বাড়ি, গ্রাম-গ্রাম ঘুরে অভিভাবকদের উৎসাহিত করতেন ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য। একই সাথে স্কুল পরিচালনায় সামর্থ্যবানদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের কাজও করতেন নিজেই। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনাবেতনে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিতেন। এমন বহুরকম গুণাবলী নিয়ে নিকলীকে একটি আলোকিত শিক্ষাঙ্গন দিয়ে গেছেন আমাদের “হেডমাস্টার” স্যার। আমাদের জীবনাচরণে তাঁর (স্যারের) ঋণ কখনোই শোধ হবার নয়। আল্লাহ স্যারকে জান্নাত দান করুন।

 

লেখক : নিকলী থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং পল্লী চিকিৎসকও ছিলেন।

Similar Posts

error: Content is protected !!