সোনালি সুরের জাদুকর মান্না দে

নাজমুল হোসেন ।।
কিংবদন্তি এক সঙ্গীতশিল্পীর নাম মান্না দে। বলিউডের ‘বেস্ট লাভ ভয়েস’ খ্যাত এ কিংবদন্তি শিল্পীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইতি ঘটল তার পাঁচ দশকের সঙ্গীতজীবনের। ফুসফুসে সংক্রমণজনিত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে ভারতের ব্যাঙ্গালোরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তির সঙ্গীতশিল্পী। এরপরও প্রকৃতির নিয়মে গানের জগতে অনেকেই আসবেন; কিন্তু মান্না দের মতো আর একজন তো হবে না।
১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন মান্না দে। বাবা পূর্ণচন্দ্র এবং মা মহামায়া দে। পরিবারের পাশাপাশি চাচা সঙ্গীতজ্ঞ কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছ থেকে সঙ্গীতচর্চায় অনুপ্রাণিত হন তিনি। তার হাত ধরেই মুম্বাইয়ে আসেন। সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন শচিন দেববর্মণের। ১৯৪৩ সালে ‘তামান্না’ ছবির গানে কণ্ঠ দিয়ে শুরু করেন চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক। এরপর হিন্দি বহু জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এ শিল্পী। এর মধ্যে দিল হি তো হ্যায় ছবিতে ‘লাগা চুনাড়ি মে দাগ’, ওয়াক্ত ছবিতে ‘এ মেরি জোহরা জাবিন’, সোলে ছবিতে ‘ইয়ে দোস্তি’ প্রভৃতি। ২০০৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘উমার’ চলচ্চিত্রে শেষ গান করেছিলেন এ শিল্পী। বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, পাঞ্জাবি, গুজরাটিসহ আরো কয়েকটি ভাষায় গান গেয়েছেন এ শিল্পী। হিন্দি মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মান্না দে ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
কেরালার মেয়ে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী সুলোচনা কুমারনের সাথে প্রেমের সম্পর্ক বিয়ের পিঁড়ি অবধি পৌঁছেছিল ১৯৫৩ সালে। তাদের দুই মেয়ে সুরমা দে ও সুমিতা দে। অকপটে বলেছেন জীবনের বড় পাওয়া তার স্ত্রী। একাধারে সেরা বন্ধু, ফিলোসফার, গাইড, সমালোচক সবই। গত বছর সেই স্ত্রীকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রায় অর্ধ শতকেরও বেশি সময় তিনি মুম্বাইয়ে কাটান। এরপর কয়েক বছর আগে ব্যাঙ্গালুরুতে বসবাস করছিলেন মান্না দে। সুরমা ও সুমিতা নামে দু’টি কন্যাসন্তান রয়েছে তার। সঙ্গীতে অবদানের জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৭১) এবং পদ্মবিভূষণ (২০০৫) অর্জন করেন মান্না দে। এছাড়া ২০০৭ সালে দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার এবং ২০১১ সালে ফিল্ম ফেয়ার লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট সম্মাননা প্রদান করা হয় এ শিল্পীকে।

মান্না দের প্রয়াণে আক্ষেপ লতার
মান্না দের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুরসম্রাজ্ঞী লতা মুঙ্গেশকর বলেন, প্রাপ্য সম্মান পাননি মান্না দে। আর তা নিয়ে ক্ষোভও ছিল মৃত শিল্পীর। মান্না দের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সঙ্গীতের স্বর্ণযুগের অবসান হয়ে গেল বলে মন্তব্য করেন লতা। তার চলে যাওয়া আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি আমার দাদার মতো ছিলেন। অসাধারণ শিল্পীর পাশাপাশি মান্নাদা এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার সাথে আমার খুব ভালো বোঝাপড়া ছিল। মান্না দের গান কবে থেকে শুনি, সেটা ঠিক করে বলা যাবে না। আমি কেন, অনেক বাঙালিই জানেন না। মান্না দের এমন কিছু গান রয়েছে, যা শুনলে মনে হয় সব বয়সের শ্রোতার জন্য, কিশোর বয়স পার হওয়ার পর থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত; মনে হয় যেন গানগুলো তার জীবন আর অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। লেখা আমাদের জন্য। যেমন অসাধারণ কথা, তেমন সুর, তেমনই গায়নভঙ্গি। কিংবদন্তি এ গায়কের সাথে থেকে চার দশকের বেশি সময় ধরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছেন বেহালাশিল্পী দুর্বাদল চ্যাটার্জি। মান্না দে প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণায় তিনি বলেন, মানুষের অনেক ভুল ধারণা আছে তাকে নিয়ে। অনেকেই তাকে গম্ভীর বলে মনে করতেন। কিন্তু তিনি তা ছিলেন না। অপরিচিতদের সাথে কথা বলতে একটু ইতস্তত বোধ করতেন শুধু। ধরাবাঁধা নিয়মকে সব সময় ভাঙতে চেয়েছেন মান্না দে। এক মুহূর্তের নোটিশে নতুন কিছু করে দেখানোর ইচ্ছা পোষণ করতেন এ শিল্পী।
অভিতাভ বচ্চন জানিয়েছেন, ‘আমরা একজন কিংবদন্তি শিল্পীকে হারালাম। তার স্মরণীয় কণ্ঠ সবসময় মনে থাকবে। তার আত্মা শান্তি পাক।’ চলচ্চিত্র নির্মাতা মহেশ ভাট টুইট করেন মান্না দে চলে গেলেন। কিন্তু তার কণ্ঠ থেকে যাবে। অভিনেত্রী শাবানা আজমী বলেন, অদ্বিতীয় এক কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন মান্না দে। এ মেরি জোহরা জাবিন, দিল কা হাল শুনলে দিলওয়ালা, পুছো না ক্যায়সি ম্যায় গানগুলোর মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন।
শিল্পী শ্রেয়া ঘোষাল জানিয়েছেন, মান্না দে, আপনার আত্মা শান্তি পাক। আপনি এবং আপনার কণ্ঠ অমর হোক।
মান্না দের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন আমাদের দেশীয় তারকারাও। সঙ্গীতশিল্পী থেকে অভিনয়শিল্পী নির্মাতা সবাই শোক প্রকাশ করেছেন।
কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমান বলেন, মান্না দের মতো মানুষ শত বছরে একবার জন্মগ্রহণ করেন। তার মতো মানুষের অবদান নিয়ে মূল্যায়ন করার জ্ঞান আমার নেই। তার সামনে বসে গান শোনার সুযোগ হয়েছিল আমার। তার প্রত্যেকটি গানের বাছাই করে গাওয়া, সুরে কথার জাদু অসাধারণ। গান ও সুরকে মনমতো করে গেয়েছেন। যে গান মানুষকে নাড়া দিয়েছে এবং দিয়ে যাবে আজীবন।
শাহীন সামাদ বলেন, ভারতে ষাট দশক ছিল স্বর্ণযুগ। সেই স্বর্ণযুগের এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি মান্না দে। তখন থেকে এই সময় পর্যন্ত একজন সতেজ, সুরকার, গীতিকার এবং শিল্পী তিনি। মান্না দে’র মতো শিল্পীর গান শুনে কান তৈরি হয়েছে। অনেক কিছু শিখেছি তার গান শুনে। গানের পরো শিক মান্না দে। এমন শিল্পী যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন। তার কর্ম তার অবদান অবিস্মরণীয়।
মিতা হক বলেন, পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্মায় যারা শুধু নিজ জাতির মাথা উঁচু করে না, সারাবিশ্বকেও সম্মানিত করে। মান্না দে এমন এক মানুষ যিনি সারাবিশ্বের মানুষের মনন, চেতনাকে নানাভাবে গানের কথা সুরে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাকে আমি বাংলা গানের বা ভারতের বলব না, তিনি সারা বিশ্বের। তার মৃত্যুতে একটা নত্রের পতন হলো। এই নত্র ল নত্রের অংশ না, গুটিকয়েক নত্রের একটি। কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র মতো একজনের রক্ত ছিল তার ধমনীতে। সেই ভার তিনি সফলভাবে বইতে পেরেছেন। তার মতো শিল্পী আর আসবে না।

Manna_Dey

শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হলো না
‘শুধু গান গেয়ে গেয়ে যেতে চাই। যে দিন গাইতে পারব না, সে দিন যেন এক মিনিটও বেঁচে না থাকি ঈশ্বরের কাছে এটাই প্রার্থনা করতেন মান্না দে। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে দেয়া সাক্ষাৎকারে নিজের শেষ ইচ্ছা এভাবেই প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তার শেষের কয়েকটা দিন কেটেছে ব্যাঙ্গালোরের এক হাসপাতালে। হাসপাতালের মুখপাত্র কে বাসুকি বলেন, ‘প্রথম ধাক্কাটা তিনি যেভাবে সামলে নিয়েছিলেন, তাতে আমাদের মনে হয়েছিল, এ যাত্রা বিপদমুক্ত। ভেন্টিলেশন খুলে নেয়া হলো। তিনি উঠে বসলেন। খুব বেশি কথা বলতেন না। তবে প্রায় সারাণ গান শুনতেন। কেরলের উৎসবের সময় কয়েকজন ডাক্তার এসে মান্না দে’র গাওয়া মালয়ম ভাষার গান তাকে মনে করিয়ে দেয়াতে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। আসলে তিনি হাসপাতালেও গানের মধ্যে ডুবে থাকতেন।
জীবনের শেষ অ্যালবাম করার একটা ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সে ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই তিনি চিরবিদায় নিলেন গত ২৪ অক্টোবর। স্ত্রী সুলোচনার স্মৃতিতে ৯৪ বছর বয়সেও এই অ্যালবাম করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। অ্যালবামের শিরোনাম ঠিক করা হয়েছিল, ‘জানি আবার দেখা হবে’। মান্না নিজেই সুর দিয়েছিলেন গান ক’খানির। মান্না দে বারবার বলতেন, ‘এই অ্যালবামটা না করে আমি মরব না।’
এত বড় শিল্পী হয়েও একটা আফসোস ছিল তার। তিনি মনে করতেন, মুম্বাইয়ে তাকে ততটা সুযোগ দেয়া হয়নি। এক সাক্ষাৎকারে ফুটেও উঠেছে তার মনের এই বেদনার কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘দেখেছি আমার গান হিট করেছে। দেদার রেকর্ড বিক্রি হচ্ছে। লোকের মুখে মুখে ফিরছে আমার গান। কিন্তু চলচ্চিত্র পরিচালক বা প্রযোজকেরা আমাকে তাদের ছবিতে নিতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না কখনো। আমি বঞ্চনার শিকার। নইলে আরো অনেক বেশি গানের রেকর্ড থাকতে পারত আমার। বাংলা গানের েেত্র আমি সুরকার হিসেবে বঞ্চিত। বাংলা ছবির প্রযোজকেরা আমাকে সুরকার হিসেবে বিশেষ সুযোগ দেননি। মনে হয়, আমার ওপর তারা সেভাবে ভরসা করতে পারেননি। আমার বিশ্বাস, আরো অনেক কিছু দেয়ার মতা আমার ছিল।’
মান্না দের বাংলা গানে প্রথম পদচারণা সুরকার হিসেবে, গায়ক হিসেবে নয়। তিরিশের দশকে ‘বালুকা বেলায় অলস খেলায় যায় বেলা’ গানখানিতে সুর দিয়েছিলেন তিনি। এর আগে তিনি বাংলা গান রেকর্ড করেননি। গানখানি গেয়েছিলেন সে সময়ের জনপ্রিয় শিল্পী সুপ্রীতি ঘোষ।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি তার উপদেশ ছিল, রেওয়াজটাই হলো আসল। আমি প্রতিদিন সকালে উঠে ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করি। তারপর দুই ঘণ্টা রেওয়াজ। রেওয়াজের ব্যাপারে নো কম্প্রোমাইজ। যথার্থ গুরু পাওয়াও বড় ব্যাপার। আমি আমার কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের পায়ের কাছে সে গান শিখেছি। তারপর শিখেছি আমান আলি খান, আবদুর রহমান খান, দবির খান, গোলাম মুস্তাফা খানের কাছে। তারাই আমার প্রেরণা।

তার কালজয়ী গান
কফি হাউজ শূন্য। কফি হাউজের শেষ অতিথিটিও চলে গেলেন। ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’- আপে জড়ানো কথা ক’টি একরাশ বিষাদ ছড়িয়ে দিয়েছে আমাদের মন ও মননে। কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে আমাদের মাঝে রেখে গেলেন কফি হাউজের বন্ধুদের জীবন্তগাথা। কেবল ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’-ই নয়, আরো অনেক কালজয়ী গান গেয়ে গেছেন মান্না দে, যা তাকে কোনো দিনই ভোলা যাবে না। সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন স্বর্ণযুগের এই কণ্ঠশিল্পী।
হিন্দি, বাংলা, গুজরাটি, মারাঠি, মালায়াম, আসাম, কানাড়া অনেক ভাষায় গেয়েছেন তিনি। তার ‘গান লাগা চুনারি মে দাগ’, ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’, ‘আবার হবে তো দেখা, ‘এই কূলে আমি, আর ওই কূলে তুমি’, ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়’, ‘যদি কাগজে লেখো নাম’, ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল’ কিংবা হেমন্তের আকাশ আজি মেঘলা’, ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’, ‘রানার রানার’, ‘পথের কান্তি ভুলে’- এসব গান যখন বেজে ওঠে তখন মনের দরোজা বন্ধ রাখার উপায় নেই।

জীবনের জলসাঘরে
সঙ্গীত যার জীবনের ধ্যান, জ্ঞান, ঈশ্বর ও প্রাণবায়ু, তিনিই মান্না দে, দীর্ঘদিন রোগশায়িত। গাওয়া গানগুলো যখন বাজতে থাকে ভয় জাগে, এই বুঝি তার প্রাণবায়ু নির্গত হবে। বয়স তো কম হলো না, ৯৪। দাপটের সাথে সুরের আবাহনে বয়ে চলেছে জীবন, বৈচিত্র্যের সুরে তার গাওয়া গানগুলো আমাদের সামনে খেলা করতে থাকে। যে যত শুনেছেন, তার তত বেশি মনে পড়বে। যারা আত্মজীবনী পড়েছেন, তারা মিলিয়ে নিতে পারবেন তার গানের সাথে জীবনের সাযুজ্য। ২০০৫ সালে বাংলা ভাষায় মান্না দে’র আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ প্রকাশিত হয়। ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনী সংস্থা আনন্দ পাবলিশার্স এ বইটি প্রকাশ করে। পরে এটি ইংরেজিতে ‘মেমোরিজ কাম অ্যালাইভ’, হিন্দিতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠি ভাষায় ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। মান্না দে’র জীবন নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে একটি তথ্যচিত্র ২০০৮ সালে মুক্তি পায়। এখানে তার আত্মজীবনী জীবনের জলসাঘরের অংশবিশেষ আপনাদের জন্য তুলে ধরা হলো।
# কফি হাউজ আমার বাড়ির খুব কাছেই ছিল। কিন্তু যে কেউ জানলে অবাক হবেন, আমি কোনো দিন কফি হাউজে যাইনি। তবে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কফি হাউজের যে ছবিটা গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার গীতিকবিতায় তুলে ধরেছেন, সেটা এক কথায় অসাধারণ। আর তার ওপর নচিকেতার ছেলে খোকা সুন্দর সুর করেছেন। আমি তো কেবল তাদের বানানো জিনিসটাই শ্রোতার কাছে তুলে ধরেছি। সব কৃতিত্ব গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের।
# আমি একটি সাধারণ গৃহস্থ ঘরের ছেলে। সেভাবেই মানুষ হয়েছি, লেখাপড়া করেছি, সেভাবেই জীবনকে দেখতে ও চলতে শিখেছি। তবে এটা ঠিক, কারো মধ্যে যদি প্রতিভা থাকে, তবে সে কিছু হতে পারবে। আমার কাকা আমার ভেতর হয়তো সে রকম প্রতিভা দেখেছিলেন। তিনিই আমাকে টেনে এনে এক দিন বলেছিলেন, ‘গান শেখো’। গানের জগতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনিই আমাকে রাস্তা দেখিয়েছিলেন। সে জন্য হয়তো আজো গাইছি।
# কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন অন্ধ। সব সময় তার সাথে একজনকে থাকতে হতো। এ কারণেই কাকার সাথে কলকাতা থেকে মুম্বাই যাওয়া। কাকাই ছিলেন আমার সঙ্গীত ভুবনের পথপ্রদর্শক। তিনি শিখিয়েছেন কী করে গান করতে হয়, সুর বাঁধতে হয়। ভীষণ বাস্তববাদী মানুষ ছিলেন তিনি। তার মতো করেই আমি জীবনটাকে দেখতে শিখেছিলাম। কাকা সব সময় বলতেন, ‘কান দুটো খোলা রাখবি। ভালো-মন্দ দুটোই শুনবি। তা না হলে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ সে পার্থক্যটা বুঝতে পারবি না।’
# গান আমার একটা প্যাশন। গানই আমার জীবন। এ বয়সেও গান করতে পারার পেছনে আর একটা ব্যাপারও হয়তো আছে, আমি স্পোর্টসম্যান ছিলাম। কুস্তিটুস্তি করে নামও করেছিলাম। সে জন্য আমার শরীরটার বাঁধুনি শুরু থেকেই একটু শক্ত ছিল। আমার বাবাকেও কৃতিত্ব দেবো এ জন্য। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, শরীর ভালো রাখতে হলে শরীরের যত্ন করতে হবে। যতটুকু খাওয়া দরকার, ততটুকু খাবে। সময়মতো খাবে, সময়মতো শোবে, সময়মতো এক্সারসাইজ করবে, সময়মতো কাজ করবে। জীবনের এই ডিসিপ্লিনটা আমাকে খুব সাহায্য করেছে। এ কারণেই আমি ৯০ বছর বয়সেও গান করতে পারছি।
# ৬০ বছরই আমার সঙ্গীতজীবন। লেখাপড়া ভালোভাবেই করেছিলাম। তবে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর সিঙ্গার হওয়াটাকেই আমি আমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে নিই। কারণ ছিল হয়তো এটাই যে, কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন আমার কাকা। কাকা বিয়েটিয়ে করেননি, নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছিলেন আমাদের। কাকার দৌলতে ভারতবর্ষের সেরা সেরা গাইয়ে-বাজিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতেন, পারফর্ম করতেন। বাড়িতে বসেই আমরা তাই ভারতবিখ্যাত সব শিল্পীর গান শোনার সুযোগ পেয়েছিলাম। সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা আমি শুনতে শুনতে নিজেই শিখেছিলাম। কাকার তত্ত্বাবধানে গান শুরু করার পর আমি কাকার ওস্তাদ দবির খাঁ সাহেবের কাছে গান শিখলাম। এরপর কাকার হাত ধরে বোম্বেতে যাওয়ার পর ওখানে কাকা আমাকে বড় বড় ওস্তাদের কাছে দিয়ে দিলেন- পাশাপাশি ফিল্মেও কাজ করতে লাগলাম।
# আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া আমার স্ত্রী। ও কেরালার মালাবারের মেয়ে। উচ্চশিতি, বোম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি ভাষায় এমএতে ফার্স্ট কাস ফার্স্ট। ওকে দেখে প্রথম দর্শনেই প্রেম বলতে যা বোঝায়, তা-ই হয়েছিল আমার। এরপর আমরা একে অন্যকে জানলাম, বিয়ে করলাম। ৫৫ বছরের বিবাহিত জীবনে সব সময়ই ওকে আমার সঙ্গী হিসেবে যেমন সেরা মনে হয়েছে, তেমনি বন্ধু হিসেবেও সেরা, যেকোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করার জন্য সেরা। ও শুধু আমার স্ত্রীই নয়; আমার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। আমার সবচেয়ে বড় সমালোচকও।
# আমার মতো একটা বাঙালির সাথে মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাটা খুব মুশকিল ছিল। তা সত্ত্বেও আমি সহজে হার মেনে নেইনি, ভালো ভালো ওস্তাদের কাছে শিখেছি। এ কারণেই আমি একটু অন্যভাবেও গাইতে চেয়েছি। বাংলা গানেও আমি এসব ইন্ট্রোডিউস করেছি। সুখের কথা, আমার বাঙালি শ্রোতারা সেটি দু’হাত ভরে গ্রহণ করেছে। বাংলা ভাষাতে আমি যত শক্তই গান করি, সে গানগুলো পপুলার হতো ও লোকে গ্রহণ করত।

সে নাম রয়ে যাবে
দীর্ঘ সাত দশকের অধিক সময় ধরে উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষকে আবিষ্ট করে রেখেছিল সুরের ইন্দ্রজালে। কাকা অন্ধ শিল্পী কৃষ্ণ চন্দ্র দে একাধারে ছিলেন তার সঙ্গীতগুরু ও প্রেরণার উৎস। বিখ্যাত কাকার সুবাদে সঙ্গীতজীবনের শুরু থেকেই উপমহাদেশের খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞদের সান্নিধ্য এবং তাদের কাছে তালিম নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। নিজে গেয়েছেন, গানে সুর করেছেন, হিন্দি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। এককথায় সঙ্গীতের প্রায় সব ক্ষেত্রেই অসামান্য প্রতিভার স্বার রেখেছেন তিনি। ভারতের বিভিন্ন ভাষায় চার হাজারের মতো গান গেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বাংলা গানের সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। এসব গানের প্রায় ৯০ শতাংশের সুর তার নিজের দেয়া। তার অসংখ্য গান প্রেম-বিরহের আবেগে বাঙালির হৃদয়তন্ত্রীতে বাজবে বহুদিন।

বিখ্যাত কয়েকটি গান
১. কফি হাউজের সেই আড্ডাটা
২. আবার হবে তো দেখা
৩. এই কূলে আমি, আর ওই কূলে তুমি
৪. তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়
৫. যদি কাগজে লেখো নাম
৬. সে আমার ছোট বোন
৭. হিমালয় আল্পসের
৮. সবাই তো সুখী হতে চায়
৯. তুমি নয়, নয় কাছে আসলে
১০. তুমি আর ডেকো না
১১. দুঃখ আমাকে দুঃখী করেনি
১২. ওই চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে
১৩. তুমি অনেক যত্ন করে দুঃখ দিতে চেয়েছ
১৪. পৌষের কাছাকাছি
১৫. খুব জানতে ইচ্ছে করে
১৬. ও ভাই যারা দেখকে চালো
১৭. সোনাতে কলঙ্ক আছে

 

একনজরে মান্না দে
নাম : প্রবোধচন্দ্র দে
ডাকনাম : মান্না
পিতা : পূর্ণচন্দ্র দে
মাতা : মহামায়া দে
গানের হাতেখড়ি : কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে
সঙ্গীতে অভিষেক : ১৯৪৩ সালে ‘তামান্না’ ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক।
গানের সংখ্যা : প্রায় সাড়ে তিন হাজার। বাংলা, হিন্দি, অসমিয়া, মালায়ম, মারাঠি, গুজরাটি, ভোজপুরি, কানাড়া, পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন ভাষায় গান করেছেন।
সম্মাননা : ১৯৬৯ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘মেরে হুজুর’, ১৯৭১ বাংলা চলচ্চিত্র ‘নিশি পদ্মে’ ছবিতে গানের জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পীর পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সম্মাননা পদ্মবিভূষণ পুরস্কার, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ভারত সরকার পদ্মশ্রী পুরস্কার ছাড়াও বিভিন্ন রাজ্য ও সংগঠনের তরফ থেকে আজীবন সম্মাননা লাভ করেন।

 

সূত্র : অন্য এক দিগন্ত

Similar Posts

error: Content is protected !!