নিকলীর ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ সর্বপ্রাচীন

খায়রুল আলম বাদল

 

কিশোরগঞ্জের প্রাচীন থানা নিকলীর সোয়াইজনী নদীতে অনুষ্ঠিত নৌকাবাইচ ভাটি বাংলার ঐতিহ্য লোক সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব, উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রাচীন নৌকাবাইচ। লোকজ সংস্কৃতির এই নৌকাবাইচে ব্রা‏হ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলার দৌড়ের নৌকা অংশ নেয়।

নিকলী উপজেলার সোয়াইজনী নদীতে আদিকাল থেকে প্রতি বছর ১ ভাদ্র অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ। এ উপলক্ষে নিকলী ও এর আশপাশ এলাকায় হিন্দু-মুসলিম প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, বর-কনে সবাইকে দাওয়াত করা হয়। ঘরে ঘরে চলে পিঠা-পায়েস তৈরীর ধূম। বর্ষার শুরুতেই দৌড়ের নৌকাগুলো সোয়াইজনী নদী ও আশপাশের হাওরে মহড়া করে। পুরো বর্ষা জুড়ে হাওর ও সোয়াইজনী নদীর বুকে দৌড়ের নৌকার মাঝিমাল্লাদের সারিগান আর ঢোল কর্তালের বাদ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। ঘাটে ঘাটে চলে ঘাটু গানের আসর। নৌকাবাইচকে ঘিরে গোটা ভাটি এলাকায় বয়ে যায় আনন্দের জোয়ার।

কিশোরগঞ্জ জেলা শহর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ২৬ কিলোমিটার দূরে বিশাল হাওর বেষ্টিত উপজেলা নিকলী সদর ঘেঁষে বয়ে গেছে সোয়াইজনী নদী। এর সাথে বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা জুড়ে মনোরম পরিবেশে স্থানীয়দের মতে বিশাল জল-স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় ভাটিবাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের এই নৌকাবাইচ। প্রতিবছর নৌকাবাইচের দিন দেশ-বিদেশ থেকে লাখ লাখ দর্শকের সমাগম ঘটে এই সোয়াইজনী নদীতে। প্রায় ৩ কি.মি. দীর্ঘ ও হাজার গজ প্রস্থ এলাকাজুড়ে নদীতে-হাওরে বাশের তৈরী নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে ছোটবড় নৌকা, ট্রলারে দর্শনার্থীদের অংশগ্রহণে কানায় কানায় ভরে জনসমুদ্রে পরিণত হয় নৌকাবাইচ এলাকা। এর অদূরে আশপাশের গাছপালা, ব্রীজ ও বাড়ির আঙ্গিনায়সহ যে যেখানে পারে দাঁড়িয়ে নৌকাবাইচের আনন্দে শরিক হয় লাখ লাখ মানুষ।

 

নৌকাবাইচের উৎপত্তি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য

নিকলী উপজেলার সোয়াইজনী নদীতে আদিকাল থেকে প্রতি বছর ১ ভাদ্র অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। নৌকাবাইচের উৎপত্তি কবে, কিভাবে হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও এ ব্যাপারে প্রচলিত রয়েছে নানা কিংবদন্তি। কথিত আছে, সোয়াইজনী নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সনাতন ধর্মের প্রচারক শ্রী চৈতন্য দেবের আখড়ার ঘাটে একদা মনসা দেবী (মতান্তরে নিকলী সুন্দরী) মনুষ্যরূপ ধারণ করে পানি আনতে যান। এসময় আখড়া ঘাটের উত্তর ও দক্ষিণ পাশ থেকে মাছ ধরারত দুই জেলে দেখতে পায় দেবীকে। মনুষ্যরূপী মনসাদেবীর অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে দুইজন জেলে একসাথে এসে দেবীকে প্রেম নিবেদন করে। এক নারী দুই প্রেমিকের প্রেমে কীভাবে সাড়া দেবেন এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেবী দুজনকে পাশের মোহরকোণা গ্রামের লাল গোসাইয়ের আখড়া থেকে নৌকা বাইচ করে তার ঘাটে আসতে বললেন। যার নৌকা আগে এসে ঘাটে ভিড়বে, তার সাথেই হবে দেবীর প্রেম। দেবীর কথা মতো নৌকা বাইচ করা হলো। কিন্তু ভাগ্যচক্রে প্রতিযোগি দুই জেলের নৌকাই এক সাথে ঘাটে এসে ভিড়ে। কেউই প্রথম-দ্বিতীয় হলো না। তাই দেবীরও কোনো মানবের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। তবে জেলেদের নির্মল প্রেমকে অমর করে রাখতে তাদের প্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছর সোয়াইজনী নদীতে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেন দেবী। সেই থেকেই সোয়াইজনী নদীতে প্রতি বছর নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ বিশ্বাস থেকে আজও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী যেকোনো নৌকা যাত্রার পূর্বে চৈতন্য দেবের আখড়ায় এসে ধান, ধূপ, পূজা-অর্চনা, যাত্রাসংগীত (এক প্রকারের সারি গান) পরিবেশনসহ সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে। আবার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার পেলে নৌকা সমেত তা নিয়ে প্রথমেই যাওয়া হয় ঐ চৈতন্য দেবের আখড়া ঘাটে। সেখানে বিচিত্র সারি গান গেয়ে দেবীকে ধন্যবাদ জানানো হয়। আর মুসলিম প্রতিযোগিরা ঐ ঘাটেই আল্লাহর নাম স্মরণ করে সারি গান গায়।

আদিকালে নৌকা বাইচ নিয়ে স্থানীয় উৎসবের কমতি ছিলো না। শ্রাবণের ২৭/২৮ তারিখ থেকে সোয়াইজনীর কূলজুড়ে বসতো মেলা। উপজেলার ঘরে ঘরে চলতো পিঠা-পায়েস তৈরীর ধূম। হিন্দু-মুসলিম প্রতিটি বাড়িতে ফিরনি-পোলাও রান্না করে বর-কনে, আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত করা হতো। গোটা ভাটি এলাকায় বইতো আনন্দের জোয়ার। দিনের বেলায় নদীর বুকে দৌড়ের নৌকার মাঝিমাল্লাদের সারিগান আর ঢোল কর্তালের শব্দ শোনা যেত, রাতে ঘাটে ঘাটে বড় বড় নৌকায় হারিকেন বা হ্যাজাইক লাইটের আলোতে চলতো ঘাটু গানের আসর। ঈদ বা দূর্গাপূজা এখানকার মানুষের জীবনে খুব বড় কোনো অনুষ্ঠান ছিল না। কিন্তু নৌকা বাইচ ছিল এ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের জীবনে বছরের সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসব। এক কথায় নিকলী উপজেলার মানুষের জীবনাচরণ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সামাজিকতার সাথে নৌকা বাইচ একাকার হয়েছিল।

সময়ের স্রোতে আকাশ সংস্কৃতির করাল গ্রাস আর মানুষের জীবনে যান্ত্রিকতার ছোঁয়া লাগার সাথে সাথে নৌকাবাইচ তথা গণমানুষের বিনোদনমূলক নিজস্ব সকল সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে প্রায় প্রতি বছরই সোয়াইজনী নদীতে নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হতো। স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে কয়েক বছর নৌকাবাইচ বন্ধ থাকে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭৭ সাল থেকে নৌকাবাইচের পুণ:প্রচলন শুরু হলেও তা চলতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এভাবে বছর, দুই বছর ফাঁক দিয়ে দিয়ে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা ১৯৯২/৯৩ সাল পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। এরপর আর নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়নি। বাইচের জন্য বিশেষভাবে তৈরী নৌকাগুলোও দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকতে থাকতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। গত তিন বছর ধরে আবারো শুরু হয়েছে নিয়মিত নৌকা বাইচ। এখন আবার পাড়ায় পাড়ায় তৈরী হয়েছে দৌড়ের নৌকা।

প্রাচীন পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুযায়ী নিকলী এলাকার নৌকাবাইচের আগে উপমহাদেশের অন্য কোথাও নৌকা বাইচের প্রচলন দেখা যায়নি। সে হিসেবেও প্রাগৈতিহাসিক কাহিনী পর্যালোচনা এবং নৌকাবাইচের জন্য রচিত সারিগানগুলো পর্যালোচনা করে নৌকাবাইচের উৎপত্তি সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তাতে নিঃসন্দেহে কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার সোয়াইজনী নদীর বুকে প্রচলিত নৌকাবাইচকে উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন এবং সর্ববৃহৎ বলে দাবি করা যায়। তাছাড়া সুদীর্ঘ কাল ধরে লোকমুখে প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে, ‘অষ্টগ্রামের আশুরা, কলিকাতার দশরা- দুনিয়ার সেরা। উল্লেখিত তথ্যাবলীর আলোকে আমাদের দাবি যথাযথ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই ‘নৌকাবাইচ’ হয়ে উঠবে নিকলীবাসীর গর্বের ইতিহাস।

 

খায়রুল আলম বাদল

বড়হাটি, নিকলী

Similar Posts

error: Content is protected !!