বর্তমানে স্মার্টফোনের কল্যাণে আমরা সবাই টাচস্ক্রিনের সাথে পরিচিত। সাধারণ মানুষের সাথে টাচস্ক্রিনের সখ্য বেড়েছে মোবাইল ফোনের কল্যাণে। শুরুতে অ্যাপল আইফোনে ২০০৭ সালে টাচস্ক্রিনের ব্যবহার করে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে সবার হাতেই টাচস্ক্রিন সংবলিত মোবাইল ফোন। এখন টাচস্ক্রিন ব্যবহার শুধু মোবাইল ফোনের মধ্যেই সীমিত নেই। বর্তমানে ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ট্যাবলেটসহ বিভিন্ন মোবাইল ডিভাইসে টাচস্ক্রিন ব্যবহার হচ্ছে। লিখেছেন আহমেদ ইফতেখার
আলো, তরঙ্গ, তড়িৎপ্রবাহ ও পদার্থের অন্যান্য ধর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে টাচস্ক্রিন কাজ করে। আঙুলের ডগা, চামড়া বা কলমের মতো একটি দণ্ডের (স্টাইলাস) সহায়তায় টাচস্ক্রিন ব্যবহার করা হয়। কিছু স্পর্শের আগেই কাজ করা শুরু করে আবার কিছুর ক্ষেত্রে কাজ করতে অনেক সময়ের (যদিও মিলি সেকেন্ডের ব্যাপার) প্রয়োজন হয়। অবাক হওয়ার কিছু নেই টাচস্ক্রিন সম্প্রতি আবিষ্কৃত কিছু নয়, ১৯৬০-এর দশকে এটি আবিষ্কার করা হয়। সময়ের আবর্তনে কোন ধরনের প্রযুক্তি সুবিধাজনক হবে, তার ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা।
রেজিস্টিভ টাচস্ক্রিন
এই টাচস্ক্রিন তৈরিতে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে রেজিস্টিভ প্রযুক্তি সর্বাধিক প্রচলিত। এ ব্যবস্থায় পর্দায় তড়িৎ প্রবাহের পরিবর্তনের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে নিয়ন্ত্রক স্পর্শের সঙ্কেত গ্রহণ করে এবং সে অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করে। দুই ধরনের (একটি ধারকীয় এবং একটি ধাতব রোধের স্তর) স্তরের সমন্বয়ে এ ধরনের পর্দা তৈরি করা হয়। স্তর দু’টি তৈরি করা হয় কাচ ও প্লাস্টিকের আবরণ দ্বারা। এর দুই পাশেই একটি সূক্ষ্ম, স্বচ্ছ পরিবাহী পদার্থের আবরণ থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই কাজের জন্য ইনডিয়াম টাইটানিয়াম অক্সাইড ব্যবহৃত হয়। এ দু’টি স্তর বায়ুর একটি স্তর বা মাইক্রো ডট দ্বারা পৃথক করা থাকে, যাতে একটি স্তর অন্যটিকে স্পর্শ করতে না পারে। আর সবার ওপরে থাকে একটি পাতলা প্লাস্টিকের আবরণী।
একটি সুষম, অদিকপরিবর্তী তড়িৎপ্রবাহ প্রথম স্তরের মধ্য দিয়ে চালনা করা হয়, যখন যন্ত্রের মনিটর কার্যকর অবস্থায় থাকে। যখন ওপরের স্তরটিতে চাপ দেয়া হয় তখন পর্দা দু’টি ওই বিন্দুতে পরস্পরের সংস্পর্শে আসে। তড়িৎ ক্ষেত্রের পরিবর্তন হিসাব করে প্রসেসর যে বিন্দুতে স্পর্শ হয়েছিল ওই বিন্দুর স্থানাঙ্ক নির্ণয় করে। স্থানাঙ্ক জানা হয়ে গেলে স্পর্শটিকে এমনভাবে রূপান্তরিত করা হয় যাতে অপারেটিং সিস্টেম সঙ্কেতটি গ্রহণ করতে পারে। স্পর্শের কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়।
রেজিস্টিভ টাচস্ক্রিনের কাজ করার জন্য এর পৃষ্ঠে চাপের প্রয়োজন হয়। এ ধরনের টাচস্ক্রিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো পানি বা অন্য কোনো পদার্থ দ্বারা আক্রান্ত হয় না বলে রেস্তোরাঁ, কারখানা ও হাসপাতালে এ ধরনের টাচস্ক্রিন ব্যবহার করা হয়।
ক্যাপাসিটিভ টাচস্ক্রিন
এই ব্যবস্থায় ধারকত্বের ধারণাকে মূলনীতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যখন কোনো বস্তুতে তড়িৎ আধান প্রবাহিত করা হয় যদি আধানের প্রবাহিত হওয়ার কোনো সুযোগ না থাকে তাহলে সেই আধান বস্তুটিতে সংগৃহীত অবস্থায় থাকে। বস্তুর এই ধর্মকে ‘ধারকত্ব’ বলে। এমন অবস্থায় কোনো পরিবাহী পদার্থ ধারকটির সংস্পর্শে এলে কিছু আধান পরিবাহিতে প্রবাহিত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সংস্পর্শ বিন্দুতে আধানের পরিমাণ কমে যায়। এই আধানের ভিন্নতা পরিমাপের মাধ্যমে কোন অংশে স্পর্শ করা হয়েছে তা নির্ণয় করা হয়। এ ক্ষেত্রে আপনার মনে একটি প্রশ্ন জাগতে পারে যে আমি তো আমার মোবাইল ফোনের টাচস্ক্রিন নিয়মিত ব্যবহার করি, তাও আমার বৈদ্যুতিক ধাক্কা লাগে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর হলো, টাচস্ক্রিনের স্পর্শের ফলে যে পরিমাণ আধান সঞ্চারিত হয় তার পরিমাণ এমন কম যে তা আমাদের বৈদ্যুতিক ধাক্কা দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।
রেজিষ্টিভ এর ন্যায় কয়েক স্তর প্রলেপের মাধ্যমে এ ধরনের টাচস্ক্রিন তৈরি করা হয়। কাচের পর্দায় একটি স্বচ্ছ ধারকের (সাধারণত ইনডিয়াম টিন অক্সাইড) প্রলেপ দেয়া হয়। যেহেতু মানবদেহও তড়িৎ পরিবাহী, পর্দার উপরিতল স্পর্শের মাধ্যমে পর্দাটির স্থির তড়িতক্ষেত্রের বিকৃতি ঘটার পাশাপাশি ধারকত্বের পরিমাপযোগ্য পরিবর্তন হয়। স্পর্শবিন্দু বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্ণয় করে নিয়ন্ত্রকের নিকট এ তথ্য পাঠানো হয় যাতে নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদিত হতে পারে।
একটি বা অনেকগুলো প্যানেল একত্রে ব্যবহার করে এ টাচস্ক্রিন তৈরি করা যায়। স্বধারকত্ব এবং পারস্পরিক ধারকত্ব দুই ধরনের ব্যবস্থা গঠন করা যেতে পারে। পারস্পারিক-ধারকত্বের ক্ষেত্রে পদার্থের একটি বৈশিষ্ট্যের সুবিধা নেয়া হয় আর তা হলো- বেশির ভাগ পরিবাহী বস্তু আধান বহন করতে সম, যদি তাদের খুব নিকটে আনা হয়। পারস্পরিক ধারকীয় সংবেদী যন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রতিটি পর্যায় এবং শ্রেণীতে একটি করে ধারক থাকে। ধারকত্ব এবং বিভবের পরিবর্তন নির্ণয়ের মাধ্যমে খুব সূক্ষ্মভাবে স্পর্শবিন্দু নির্ণয় করা সম্ভব। পারস্পরিক ধারকীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে পর্দায় একাধিক আঙুল বা হাতের তালু বা পরিবাহী স্টাইলাস ব্যবহার সম্ভব।
তড়িৎ অপরিবাহী কোনো বস্তুর স্পর্শ এ ধরনের প্রযুক্তি নির্ণয় করতে পারে না। আর এই অসুবিধাটি ওইসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেখানে আপনি সরাসরি আপনার হাত ব্যবহার করতে পারবেন না। এ ধরনের হতে পারে খুব শীতল আবহাওয়ার অঞ্চলের ক্ষেত্রে যখন আপনাকে সব সময় মোজা পরিহিত অবস্থায় থাকা লাগে।
ইফ্রারেড টাচস্ক্রিন
এর অন্যতম সুবিধা হলো, এটি যেকোনো ধরনের বস্তুর (আঙুল, দস্তানা পরিহিত আঙুল, এমনকি কলম) স্পর্শকে সঙ্কেত হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। তবে এ ব্যবস্থার অসুবিধা হলো, পর্দার সংবেদী অংশটুকু পর্দার কিছুটা ওপরের দিকে থাকে। ফলে আঙুল বা অন্য কিছু দিয়ে স্পর্শের আগেই কিছু সময় স্পর্শ লিপিবদ্ধ করে ফেলে। তা ছাড়া ধূলিকণার কারণে পর্দায় ভুল স্পর্শ লিপিবদ্ধ হতে পারে, যেহেতু যেকোনো বাধাকেই এ ধরনের টাচস্ক্রিন স্পর্শ হিসেবে বিবেচনা করে।