হাওরবাসীদের হতাশ করছে হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তর

আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।

গত বছর চৈত্রের আগাম বন্যায় সর্বস্বান্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন অধিদপ্তরের। অথচ এই সরকারি প্রতিষ্ঠানটি কোনো ভূমিকাই রাখেনি তাদের জন্য। বরং চৈত্রের ওই বন্যার সময় অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ একাধিক কর্মকর্তা ছিলেন বিদেশ সফরে। এ মৌসুমে হাওরবাসী আশায় বুক বেঁধেছিলেন, গতবারের ভুল শুধরে নিয়ে এবার নিশ্চয় হাওরবাসীর পাশে দাঁড়াবে এই সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু হা-হতোস্মি! হাওরবাসীর এত দুর্দশার পরও ঘুম ভাঙেনি এই অধিদপ্তরের। বরং গত মৌসুমের চেয়েও লজ্জাজনকভাবে ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকাই পালন করছে কথিত হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর। এই শ্বেতহস্তী পুষতে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে সরকারকে প্রতি মাসে ব্যয় করতে হচ্ছে মোটা অংকের রাষ্ট্রীয় অর্থ।

কিশোরগঞ্জ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে চরম হতাশার চিত্র পাওয়া গেছে। যা দেখে শুধু বলা যায়- অধিদপ্তরের বড় বড় কর্মকর্তা রাজধানী ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে বসে মোটা অংকের বেতন-ভাতাই উত্তোলন করে যাচ্ছেন মাসে মাসে।

হাওরের উন্নয়নে এই অধিদপ্তরের কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য কর্মসূচি চোখে না পড়লেও অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মজিবুর রহমান মিয়া এ প্রতিবেদককে জানান, কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ে জনবল না থাকায় পরিকল্পনা থাকলেও অনেক কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও তিনি দাবি করেন, হাওরের সার্বিক উন্নয়নে ইতিমধ্যে ব্যাপকভিত্তিক সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এই সমীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর লাগসই কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে হাওরবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে বলে তিনি জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। আর সদস্য সচিব হচ্ছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। এ ছাড়া আরও ১৬টি মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন। অথচ এত শক্তিশালী জাতীয় কমিটি থাকা সত্ত্বেও গত দুই বছরে অধিদপ্তরের ১২১টি সৃষ্ট পদে জনবল নিয়োগ দিতে না পারায় হতাশা ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কিশোরগঞ্জের সুধী সমাজ।

কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের তারাপাশা এলাকায় ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর’-এর আঞ্চলিক অফিসটি অবস্থিত। গত সোমবার প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় নীরব-নিস্তব্ধ চারপাশ। কার্যালয়টির অবয়ব দেখে মনে হতে পারে, কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তির বিশাল বাংলো বাড়ি। আরও একটু সামনে অফিসের সব কক্ষ তালাবদ্ধ। এমনকি কক্ষগুলোর প্রধান ফটকেও তালা ঝুলছে। অফিস সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে স্টাফ কোয়ার্টার। দরজা বন্ধ সেগুলোরও। অনেক ডাকাডাকি করার পর একজন বেরিয়ে আসেন। তিনিই এ অফিসের একমাত্র ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. ইকবাল হোসেন মিয়া। আরেকজন পিয়ন আছেন। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী না থাকায় পিয়ন সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ অফিসে আসেনি। ইকবাল হোসেন জানান, পিয়নের কাজ না থাকায় সে আসেনি। তবে খবর পেলে অবশ্যই এসে পড়ত।

পরে দুপুর ১২টার দিকে গেটের তালা খোলা হয়। ভেতরের সব কক্ষের টেবিল-চেয়ার ধুলো-বালির আস্তরণে ঢাকা। বিশ্রাম কক্ষের সোফাগুলোতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো বালাই নেই।

এলাকাবাসী জানান, রাষ্ট্রীয় অর্থে জনগুরুত্বপূর্ণ একটি কার্যালয় স্থাপিত হলেও এ কার্যালয়ের কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না। এমনকি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী কারা, সেটাও তারা জানেন না।

ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. ইকবাল হোসেন মিয়া বলেন, ‘২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর থেকে তিনি এ কার্যালয়ে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু লোকবল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় অফিস থেকে।’ হাওর সম্পর্কে কী তথ্য আছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাওর সম্পর্কে তার কাছে কোনো তথ্যই নেই।

বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মুজিবুর রহমান জানান, ঢাকায় গ্রিন রোডে প্রধান কার্যালয়ে আছেন তিনি। যোগদানের পর অধিদপ্তরকে গতিশীল করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু কার্যালয়ে কর্মকর্তা ও জনবল না থাকায় দৈনন্দিন দাপ্তরিক কাজকর্মে গতি আনা যাচ্ছে না।

কিশোরগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আবদুল গণি বলেন, ‘কোনো সরকারি দপ্তর যদি জনগণের প্রয়োজনে না লাগে, তবে তার পেছনে জনগণের করের টাকা ব্যয় করাও এক ধরনের দুর্নীতি।’

সূত্র : হাওরবাসীর পাশে নেই হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তর  [সমকাল, ২৬ মার্চ ২০১৮]

Similar Posts

error: Content is protected !!