: আম্মা, আমি বুবুদের জন্য ইফতারী বানাচ্ছি।
: সেটা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি। খামোখা বলছো কেন?
: কারণ আমি আর কোন কথা খুঁজে পাচ্ছি না।
মমতাজ এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে নেহার দিকে তাকালেন। কাটিং বোর্ডের ওপর পেঁয়াজ কাটছে আর পেঁয়াজুর ডালে মেশাচ্ছে। মরিচ কাটছে মিশাচ্ছে। ধনিয়া কাটছে তারপর মাখাচ্ছে।
একবার ভাবলেন বলেন, সবগুলো একসাথে কেটে লবণ মেখে ভাল করে মলাই দিয়ে একবারেই তো ডাল বাটার সাথে মিশিয়ে ফেলা যায়। অথচ সে তা না করে বারে বারে হাত ধুচ্ছে, কাটছে, মাখাচ্ছে, আবার হাত ধুয়ে কাটছে। কাণ্ড বটে। কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। দেখেই গেলেন শুধু। বলতে গেলে আরো কিছু থিউরীই শুনতে হবে। মেয়েটি এম. এস করেছে পদার্থবিদ্যায়। তবে প্রায়ই তার মনে হয় মেয়েটি খুবই অপদার্থ। কিন্তু তিনি নিজে মুখে কিছু না বললে কি হবে মেয়েটি বলেই চলেছে,
: কাল আপনি বলে গেলেন, আমার শ্বশুরকে চা-দিয়েই ফিরে আসবেন। আমি কাঁদছিলাম। আপনি দেখেছেন। কিন্তু ফিরে আসেননি।
: আমি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
: গতকালকে বাবা আপনার জন্য হলুদ রংয়ের একটা শাড়ি আনালেন। আজকে এই একটু আগে বুবু-রা ফিরলেন শপিং থেকে, শুনলাম আরো দুটো হলুদ শাড়ি এনেছেন। বাবার তরফ থেকে ওনাদের জন্য গিফট ।
বলে তেলের মধ্যে ছ্যাত ছ্যাত করে পেঁয়াজু ছাড়ছে। ভাজছে। আর কিছু বলছে না। মুখ বন্ধ করে আছে। যাক মেয়েটা তাহলে মুখ বন্ধও করে রাখতে পারে! না পারে না, আবার মুখ খুলেছে। বলছে,
: গিফট সবাইকে দিলে কি অসুবিধা?
: ওরা বিদেশ থেকে আমাদের দেখতে এসেছে। ক’টা দিন থাকতে এসেছে। ওদের তো গিফট দিতে হবে, না, কি বল?
: বুবুরা তো সারাদিন বাজারেই থাকছেন। ১৫ দিনের জন্য এসে শাড়ি পাচ্ছে, তাহলে তো আমি আছি দুই বছর। ৩৬৫ যোগ ৩৬৫ প্রায় ৭৩০ দিনের মতন। আমার তো তাহলে আরো অনেক বেশি শাড়ি পাওয়ার কথা।
মমতাজ বেগম এবার অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। একবার হাসিও পেয়ে গেল। মেয়েটা কি চালাক না বোকা এ সমস্যাটার সাথে কুটনা, দুষ্ট না অভিমানী এ সমস্যাটাও যোগ হচ্ছে।
ভাজা পেঁয়াজুগুলো টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে গিয়ে ৭/৮টা একটা বাটি করে তার সামনে রেখে দিয়ে বললো,
: একটু আগে আপনার বমি হওয়ায় রোজা যে আপনাকে তালাক দিয়েছে সেটা আমি জানি, ঐ পেঁয়াজুগুলো খেয়ে নিন।
যেতে যেতে থেমে গিয়ে আবার বললো,
: আমার নিজের মা হলে কালকে আপনি অবশ্যই আবার ফিরে আসতেন, দেখার জন্য, কেন আমি কাঁদছি। আমার নিজের বাবা হলে হলুদ শাড়ি আমিও একটা পেতাম।
এবার নেহা কথাটা বলেই চলে গেল ডাইনিং রুমে।
মমতাজ বেগম এসেছিলেন হামিদ সাহেবের জন্য এক কাপ চা বানাতে, হামিদ সাহেবও আজকাল রোজা করতে পারছেন না। তবে চা না বানিয়ে ঐ ভাবেই তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন আর আনমনে কত কি ভাবতে লাগলেন।
কাজের বুয়া আকলিমা’র মা, বহুবছর এ বাড়িতে, হঠাৎ বললো,
: মা আর শাশুড়ী কি এক হয় কখনো, না বাপ আর শ্বশুর এক হয়। এত লেখাপড়া জানা বৌ আনছেন, এটুকু না বুঝলে কেমনে হইবো।
মমতাজের বুকটা হঠাৎ চিন চিন করে উঠলো। মেয়েটি এক ভাবতে চাচ্ছে, তারা দুই-ই থেকে যাচ্ছে। ‘এক’-এ আর পৌঁছাতে পারছে না। তাইতো, ওর জন্য একটা শাড়ি আনার কথাটা একবার মাথায় এলো না কেন? ইচ্ছে করে যে আনা হয়নি তা তো নয়। ব্যাপারটা গুরুত্বের ভেতরই আসেনি।
নেহা ফিরে এসেছে। পেঁয়াজুর সাথে খাওয়ার জন্য ধনিয়াপাতার চাটনী বানিয়েছে। তাই নিয়ে চলেও যাচ্ছে।
: শোন, ভেবে চিন্তে বা ইচ্ছে করে ঘটনা দুটো ঘটাইনি।
: আমি জানি। আমাকে খুশি না করলেও চলে, আমি ধর্তব্যের বাহিরে তাই ঘটনা-টা ঘটেছে। আপনারা আমাকে বিয়ে করিয়ে আনলে আমার অধিকার বোধ হয় বাড়তো। গুরুত্বও।
: সবই যখন বোঝ তখন আমি আর কি বলবো।
: আমার ভাবনাগুলো যে ঠিক নয় সেটাই বলবেন।
নেহা আবার প্রস্থান করলো। মমতাজের মনে হলো মেয়েটি বোধ হয় কান্নাও লুকাতে চাইলো। মায়া লাগছে আবার বিরক্তও।
চা-সহ শোবার ঘরে ঢুকে দেখলেন হামিদ সাহেব বসে বসে পেঁয়াজু চিবুচ্ছেন। সাথে এক-কাপ চাও আছে। কে চা দিল? নেহা কি? নেহাকে তো দেখলেন তিনি পেঁয়াজু বানাতে। চা বানালো কখন।
: চা কে দিল?
: নেহা। পেঁয়াজুও দিল। খুবই সুস্বাদু।
: আর চা কেমন হয়েছে?
: ভাল, বেশ ভাল। মেয়েটা ভালো চা বানাতে পারে ।
: এবার থেকে ও-কেই তাহলে বলো, ও তোমাকে চা করে দেবে।
: সেও তো তাই বলে গেল। তোমাকে বিরক্ত না করে তাকে ডাকতে বলেছে।
মমতাজ নিজেই অবাক হলেন, কেন যে সে বিষয়টা খুশি মনে নিতে চাচ্ছে না বা পারছে না। বৌ শ্বশুরের সেবা যত্ন করছে এতো ভাল কথা, অথচ সে যেন কেমন কেমন বোধ করছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে নেহা তাকে দেখালো তার চা-ও বাবা পছন্দ করে। কিন্তু চা-টা সে বানালো কখন। সে তো হাত ধুতে আর পেঁয়াজু বানাতেই ব্যস্ত ছিল।
: তুমি কি জান, তোমার পুত্রবধূ খুবই রাগ করে আছে, হলুদ শাড়ির জন্য।
হামিদ সাহেব চা পানেই ব্যস্ত। চোখ পত্রিকার উপর। সকালের পত্রিকা বিকেলে পড়া এ কেমন ধরনের বাতিক মমতাজ তা বুঝে উঠে না। আগে খোঁচা দিতেন, এ কারণেই পুলিশকে সব সময় লেট লতিফ, সকালের জিনিস বিকেলে ধরে। তখন চাকুরিতে ছিলেন। রাগ করতেন না। উল্টো হাসতেন। বলতেন, “It is better to be late then never”. মমতাজ বেগম অবশ্য এখন আর পুলিশী কাজকর্ম নিয়ে কিছু বলেন না। বুড়ো বয়সে এই লোক পুলিশের বিরুদ্ধে কিছু শুনলেই ক্ষেপে যান। একদিন আমের এসে বললো,
: বাংলাদেশের পুলিশবাহিনী পুরোপুরি তুলে দিলে কি অসুবিধা। বিশ্বের সব রিপোর্টেই তো বলা হচ্ছে এরাই দুর্নীতিগ্রস্ত। হামিদ সাহেব অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,
: দেশের আইন শৃংখলা তাহলে কিভাবে রক্ষা হবে।
: সবার হাতেই একটা করে বন্দুক দিয়ে দিলেই হবে।
: তারপর জোর যার মুল্লুক তার, সবাই শো-ডাউনে নেমে পর। দেশটা রণক্ষেত্রে পরিণত হোক। এইসব মূর্খের মতন কথাবার্তা শিখায় কে তোদের?
তারপর দুইতিন ঘণ্টা পর্যন্ত চললো তর্ক-বিতর্ক। বড় ছেলে দাদনও এসে যোগ দিল। নেহাও কম না। সদ্য তখন বিয়ে হয়েছে। সেও এসে পুলিশের বিপক্ষে দাঁড়ালো, তাও আবার পুলিশের বাড়িতেই।
সবাই চলে যেতেই সে রাতে বহুক্ষণ মনমরা হয়ে ছিলেন হামিদ সাহেব, একসময় মমতাজকে বললেন,
: আজ বড় লজ্জা লাগছে পুলিশে চাকুরি ছিল বলে, ভাগ্যিস রিটায়ার্ড করেছি, না হলে আজ গিয়েই ইস্তফা দিয়ে দিতুম। আমার ছেলে মেয়েরাই ভাবছে পুলিশ এত খারাপ, যারা জন্ম থেকে দেখে এসেছে তাদের বাপ একজন পুলিশ অফিসার, তাহলে এদেশের বাদবাকী মানুষ কি ভাবছে!
মমতাজ একবার ভাবে বলে, ‘তুমি যদি একজন সৎ পুলিশ অফিসার হতে তাহলে আজ ছেলে মেয়েরা আপামর পুলিশের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ, বিদ্বেষ প্রকাশ করতো না। এদেশে কি সৎ পুলিশ অফিসার নেই? না থাকলে এই দেশটা চলছে কেমন করে। আছে। তবে তাঁর ছেলে মেয়েরা তাদের দেখছে না। পত্র পত্রিকাতেও তাদের দেখা যায় না। তারা নিভৃতচারী।’
বলা হয় না কথাগুলো। মানুষটাকে অপমান করতে তার বড় কষ্ট। তার সামনে এলেই এ মানুষ শিশুর রূপ ধারণ করে।
এখনও চেয়ে আছেন অবাক চোখে। অবাক হয়েই বলছেন,
: হলুদ শাড়ির জন্য রাগ করেছে, মানে? লাল শাড়ির জন্য রাগ করতে কে মানা করেছে?
: মেয়েদের দিয়েছো, আমাকেও। সে বাদ পড়েছে, তাই। ও ঘরে থাকে অথচ ওকে তোমরা চোখে দেখ না, এ কেমনতর ব্যাপার!
হামিদ সাহেব হঠাৎ যেন খুব লজ্জিত হয়ে পড়লেন। ‘ছিঃ ছিঃ এতো বড় ভুল হয়ে গেল’- এরকম ভাবে তাকাতে লাগলেন তার দিকে।
: তুমিই না একটু মনে করিয়ে দেবে। এত কিছু কি আমি বুঝি না জানি। মেয়েরা সামনে ছিল তাই ওদের বললাম কিনতে।
: যাই হোক, তোমার আদরের বৌ-মা গোস্সা করেছে।
হামিদ সাহেব মৃদু হেসে বললেন,
: তুমি খুব ভাল করেই জান, ঐ মেয়ের সাথে আমার যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ। প্রেমের বিয়ে। পালিয়ে বিয়ে। ওরা আছে আমাদের সাথে, তবে থাকছে তো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, ওদের মতন।
: তাতেও তার আপত্তি আছে।
: মানে?
: জানি না এত কথা। অত কথা বলতে আমার খুব বিরক্তি লাগছে।
: ঠিক আছে, পারুল বকুলকে ডাক, বলি ওর জন্যও একটা শাড়ি আনতে।
ডাকতে হলো না, দু’বোন এক সাথে এসে রুমে ঢুকলো। হাতে শাড়ির প্যাকেটও।
: বাবাকে দেখাতে এসেছি আমাদের আজ কিনে আনা শাড়িগুলো।
বকুল বিছানার উপর শাড়িগুলো মেলতে লাগলো। তিনটে প্রায় একই ধরনের হলুদ রংয়ের শাড়ি।
মমতাজ জিজ্ঞেস কররেন, তিনটে কেন?
: বাবা তো তিনটে আনতে বললেন, ঘরে মেয়ে ক’টা আম্মা!
চেয়ে দেখে হামিদ সাহেব হাসছেন, মৃদু মৃদু।
: তুমি বলেছো?
মমতাজেরও হাসি পেয়ে গেল।
: বৌ-কে বলিসনি কেন, ওর জন্যেও শাড়ি আনা হয়েছে।
: Surprise দেওয়ার জন্য। বাবা দেবে তাই এখান থেকেই জানবে।
: আর সে তো রেগে ব্যোম হয়ে আছে।
: অভিমান করেছে মা, রাগ করেনি।
পারুলের কথাটা মমতাজের ভাল লাগলো। মেয়েটা সবকিছু বড় Positive ভাবে দেখে। দেখতে পারে। সুন্দরভাবে দেখার এই ক্ষমতাটা সে পেয়েছে সম্ভবতঃ তার নানার থেকে।
মমতাজের আনমনে বাবার কথা মনে পড়ে যায়। ছোট থেকেই অবাক হয়ে দেখেছে বাবা কত অসুন্দরের মাঝ থেকে সুন্দরটা খুঁজে নিতেন। সব কিছুরই ভালটাই গ্রহণ করতেন। সেই বাবা কখনো তার জীবনের সবচেয়ে বড় মোড়টাকে গ্রহণ করেননি। আজও আনমনে প্রায়ই ভাবেন, তবে কি খুব কুৎসিত কিছু সে ঘটিয়েছে, এতটাই কুৎসিৎ যে বাবা শেষ দিন পর্যন্ত তার মুখ দেখেননি। এক অমানুষকে ছেড়ে একটা মানুষকে ভালবেসে ঘরছাড়া কি এতটাই শাস্তিমূলক।
ছেলেমেয়েগুলোও কেউ কোনদিন নানার বাড়ি দেখেনি, যেতে পারেনি। মা এসে মাঝে মধ্যে ঘুরে গেছেন তাও অবশ্য বাবার অজান্তেই। চির জীবনের জন্য বাতিল, বাদপড়া একজন মানুষ, ত্যাজ্য, আলাদা হয়ে যাওয়া একটি প্রাণী সে।
গ্রামের বাড়িটা এখনও খুব মনে পড়ে। যদিও ঝাপসা হওয়ার পথে ঐ গ্রামের পথ ঘাট, অলিগলি, শৈশব-কৈশোর। প্রায় কেন যেন মনে হয় তাদের গ্রামের নাম শিমুলতলী। অথচ নামটা তা না। নামটা হচ্ছে ‘গাজীর ঘোনা’। অথচ তার কেন যে মনে হয় ঐ গ্রামের নাম শিমুলতলী! হামিদ সাহেবকে একদিন তা বলতে উনি বললেন,
: ঐ সময় আর ঐ গ্রাম তোমার কাছে এখন স্বপ্ন, স্বপ্নেই ওখানে যাওয়া-আসা কর তুমি। মনে মনে। কল্পনাতে। তাই এমন একটা নামও মন তোমাকে তৈরি করে দিয়েছে। ৩৫ বছর ধরে অদেখা এক ভালোলাগার জগৎকে নতুন একটা নাম তো দেয়াই যায়। আজ দেখতে পেলে দেখবে, ‘গাজীর ঘোনা’ একেবারেই বদলে গেছে, সবকিছুই অপরিচিত।
: পুলিশের লোকজন কি মনোবিজ্ঞানীও হয় নাকি?
: হতেই হয়। না হলে বুঝবে কিভাবে চোর এখন কি ভাবছে, কিভাবে এগুবে।
: ভাল, ভাল।
মুখে বলেছিল ভাল ভাল, কিন্তু মনে মনে জানে আসলেই খুব ভালো মন গবেষক হামিদ উদ্দীন। প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল বেদনার চরে, আশ্চর্য সেই বেদনার চর, নামটাও তারই দেওয়া, বসেছিল সে নদীর তীরে মনের ভেতর এত কষ্ট পুষে যে সমগ্র পৃথিবীটাই বেদনাময় মনে হচ্ছিল। হঠাৎ কোত্থেকে হামিদ উদ্দিন উদয় হলেন। পরনে পুলিশের পোশাক। জানতে চাইলেন, লোকাল নাম কি এ জায়গার? ডুবে ছিলো বিষণ্নতায়, বিষণ্ন দু’চোখ তুলেই বলেছিল, ‘বেদনার চর’।
: এ নামে এখানে কিছু নেই।
মমতাজ বেগমের তখন বয়স আর কত, এই ১৯/২০, উত্তর না দিয়ে চুপচাপ নদীর দিকে চেয়ে থেকেছিলেন। এক বদ লোকের বউ তখন তিনি, মরে যেতে মন চাইতো সারা বেলা।
: আপনি মনে হচ্ছে বেদনার ভেতর রয়েছেন তাই সর্বত্র বেদনা দেখছেন। আমি রয়েছি বিপদে। তাই আপনার চারপাশে বিপদ দেখছি। বাসায় চলে যান। এখানে কিছু চোর গুণ্ডা আশে-পাশে লুকিয়ে আছে। ধড়-পাকড়াও, ক্রস-ফায়ারিং চলবে। তাড়াতাড়ি সরে যান এখান থেকে।
: ক’জন মারা পড়বে?
: একজনও না। বাসায় যান।
: মারা পড়লে কি করবেন?
: আপনাকে ডাকবো কাঁদবার জন্য।
মমতাজের তখন হাসি পেয়ে গেল। ভালভাবে তাকালেন লোকটার দিকে। কী সুন্দর একজন মানুষ। পুলিশের লোক এত সুন্দর হয় নাকি!
একজন সেন্টিকে ডেকে হামিদ উদ্দীন তাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে বললেন।
কতকাল আগের কথা। অথচ সেই প্রথম দেখার দিনটা এখনও মনে পড়ে। প্রথম দেখাতেই ভালোলাগা। হামিদ সাহেবের অবশ্য সেদিন কিছুই নাকি মনে হয়নি, ব্যস্ত ছিলেন দায়িত্ব নিয়ে, নতুন নতুন চাকুরি, নতুন নতুন জোস। সব কিছু নির্মল পবিত্র করার মহান ভাব ধারায় তখনও তিনি উদ্বুদ্ধ। সময়ে হামিদ সাহেবের সেই মনোভাব বদলে গেছে। সে নিজেও একসময় পৌঁছে গেছে আনন্দ নগরের তীরে। বহু দূরে ফেলে আসতে পেরেছে বেদনার চর।
একটাই শুধু বেদনা। বাবা কোনো দিনই তাকে আর ক্ষমা করলেন না। কোনো ভাবেই না। এত অসাধারণ একজন মানুষ কোনোভাবেই যেন তার জীবনের এই যাপনটাতে কোনো সৌন্দর্য্যই খুঁজে পেলেন না। আজ যে ঢাকা শহরে তার এই বিত্ত, প্রতিষ্ঠা, ঐশ্বর্য্য সবই ম্লান, অর্থহীন মনে হয় যখনই মনে পড়ে বাবাকে, বাবার ক্ষমাহীন মুখটাকে। বুকটা একদম খালি হয়ে যায়। চার দিকের এতজন, এতকিছু, তারপরও সবকিছু শূণ্য বোধ হয়। একা লাগে। খুব একা। বাবা বাবা করে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
হামিদ সাহেবের কথায় হঠাৎ যেন তার কোথা থেকে ফিরে আসা হল।
: মমতা, তোমার বৌ-কে ডেকে শাড়িটা দাও।
: আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি ওকে দাও।
বকুল বললো,
: মা, আমি ডেকে আনছি, তুমি দাঁড়াও।
: না, আমি যাচ্ছি, তুই থাক। ওকে বলে দিস রাতে এই শাড়ি পরে যেতে আমাদের সাথে।
বকুল তরতর করে জিজ্ঞেস করলো,
: আজ রাতেই আমাদের তুমি চায়নিজ খাওয়াচ্ছ বাবা? দেখ কালকের মুভি দেখার Plan-এর মতন যেন আবার বাতিল না হয়। এ হচ্ছে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপার।
হামিদ সাহেব হাসলেন।
পারুল বললো,
: তুই জীবনেও চাইনিজ খাসনি, না!
উত্তরে বকুল খিলখিলিয়ে হাসলো, যেন জীবনেও খায়নি।
তারপরে বললো,
: দাদন এসে এবার আবার না বললেই হয় শহরের সব ক’টা রেস্তোরাঁতে বোমা পোঁতা আছে। বুম বুম বুম। গতকালকে বলেছিল সিনেমা হলে বোমা পোঁতা আছে। সবাই গৃহবন্দী জীবন যাপন কর। ঘর হতে এক পা দিয়ে কেহ বাহিরে যাবে না। গেলে, বোমার ঠেলায় শেষে সবার দেখা যাবে একটা করেই পা অবশিষ্ট আছে। কিন্তু সে তো জানে না এক পা নিয়েই তখনও বেরুতে হবে চাইনিজের জন্য।
হি হি করে এবার সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ছে। এই মেয়ের কথা এর থেকে আর কি ভাল হতে পারে। এরকমই আজগুবি হবে। তবে মমতাজের দৃশ্যটা ভালো লাগছে। বাপ আর মেয়েদের মিলিত হাসির মধ্যে কেমন যেন একটা অপূর্ব লহরী আছে। বাপ আর মেয়ে এক সাথে হাসছে, কী সুন্দর এই দৃশ্যটা, আহারে। মমতাজের চোখে পানি এসে যায়। এই হাসির সাথে সে হাসতে পারছে না। গ্রাস করেছে বিষণ্নতা। অতীত। বাবাকে মনে পড়ছে। মনে পড়ছে বাবার একমাত্র মেয়ে সে। হঠাৎ যেন জড়িয়ে ধরে এক কষ্ট। প্রায়ই হয়। হঠাৎ হঠাৎ কষ্টটা তাকে চেপে ধরে। বুঝতে পারে এটাই বাবার অভিশাপ। এটা থাকবে তার সাথে। আজীবন। চিরকাল। বারান্দা পেরুনোর আগেই দেখলো, নেহা হুটহাট করে ছুটে আসছে এদিকেই। চুলাতে কি আগুনই ধরিয়ে দিল নাকি।
কি হয়েছে জিজ্ঞেস করার আগেই নেহা বললো,
: আম্মা, সবাই হাসছে।
ও আল্লাহ যেন অসম্ভব কিছু। নেহার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থেকে ভাবলো বলে, ‘তবে কি তোমার মতন সারাদিন চেঁচাবে, বা কাঁদবে।’
বললেন না। মনটা ভাল নেই। শুধু বললেন,
: তোমার কি হাসতে ইচ্ছে করছে? তাহলে যাও, তুমিও ওখানে গিয়ে হাস গে।
দেখা গেল নেহা বেশ ছুট ছুট করেই ঐ রুমের দিকে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মমতাজ নেহার দ্রুত গমন দেখলেন। মেয়েটার জন্য মায়াই লাগছে। শুনেছে ঐ মেয়েটির বাবাও মেয়েটির সাথে গেল দু’বছর ধরে কথা বলেন না। দাদনকে বিয়ে করার শাস্তি। তবে মেয়েটি বাপের বাড়ি যাচ্ছে আসছে। দাদন যায় না। বেহায়া না সে। মেয়েটির আরো দুটো বোন আছে শুনেছে। দেখেনি কখনও। তারা প্রায় এ বাসায় ফোন করে। আসেনি কেউ কখনো।
হঠাৎ নেহা ফিরে আসলো, হাতে একটা টিস্যু বক্স।
: আম্মা, এটাও সাথে নিয়ে যান।
: কেন।
: আপনার চোখে পানি পানি আসি আসি করছে। আপনি সম্ভবত পেছনের ঝুল বারান্দাটাতে এখন গিয়ে বসবেন, কিছুটা সময় কাঁদবার জন্য, তাই দিচ্ছি।
টিস্যু বক্সটা একরকম হাতের মধ্যে জোর করে গুঁজে দিয়ে দ্রুত গমন করতে করতে বললো,
: আমি হাসতে যাচ্ছি, আপনি কাঁদতে যান আম্মা।
মমতাজ অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন। মেয়েটি সবই খেয়াল করে। হাসিমুখে বাদরামীও করে। সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে কতশত লক্ষ কোটি মেয়ে রয়েছে। শুধু এই একটি মেয়েই নির্ধারিত হয়েছে তার সাথে তার সংসারে থাকবার জন্য! কেমন করে এ মেয়েকে পর ভাববে সে, কেমন করে ভাল না বেসে পারবে। ভালবাসা নিজে নিজেই জন্মায় বুকের ভেতর। সে তার গন্ধ পাচ্ছে।
বাবার জন্য উথলে উঠা কষ্টটাও হঠাৎ যেন থিতিয়ে যাচ্ছে।
ঝুল বারান্দাটাতে মমতাজ পা ঝুলিয়ে বসে থাকেন। টবে টবে বারান্দাটা ভরে আছে। ফুলের কী সুন্দর খুশবু আসছে। পাঁচ মিশালী ফুলের গন্ধ। বাঁ দিকে প্রথম জানালাতে চোখ পড়তেই দেখলো তার তিন বিদেশী নাতিপুতি তার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে, হাত নাড়াচ্ছে। ঐ রুমে AC চলছে। জানালা বন্ধ। ওরা কি বলছে বোঝা যাচ্ছে না। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে ওরা বাংলাদেশ দেখছে, তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি জন্মস্থান দেখছে। তার বুকের মাঝেও উঁকি মারে ‘গাজীর ঘোনা’। থাক মমতাজ ভাবতে চায় না, চেয়ে থাকে আগামীতে, তার তিনটি প্রিয় মুখে।