তিন শর্তে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে ঐক্যফ্রন্ট

আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।

সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্য থেকে শর্তসাপেক্ষে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার মানতে রাজি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তবে শর্ত হিসেবে সংসদ ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ভোট গ্রহণ করতে হবে। টেকনোক্র্যাট কোটায় জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয় ঐক্যফ্রন্ট বা সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দলগুলোর মধ্য থেকে মন্ত্রী করা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সাজা স্থগিত করতে হবে। এ শর্তগুলো পূরণ হলে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে ঐক্যফ্রন্ট। জোটের একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

ঐক্যফ্রন্ট সূত্র জানায়, তিন প্রধান দাবি মেনে নিলে সাত দফার অন্য দাবিগুলোর ব্যাপারে বেশি জোর দেবে না জোটটি। আগামীকাল বুধবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সঙ্গে গণভবনে দ্বিতীয় দফা সংলাপে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে এ রূপরেখা দেবে বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সমন্বয়ে গঠিত ঐক্যফ্রন্ট। প্রস্তাবিত রূপরেখায় বিকল্প হিসেবে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানানোর কথা জোটের কোনো কোনো নেতা চাইলেও নানা হিসাব-নিকাশ করে শেষ মুহূর্তে তা বাদ দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য বিগত দশম সংসদ নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনার সরকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেওয়ার প্রস্তাব করলেও তা প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন বর্জন করেছিল এখনকার ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক দল ও তৎকালীন সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাবন্দি থাকা এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিদেশে থাকায় বর্তমান বাস্তবতা মেনে কিছুটা ছাড় দিতে রাজি হচ্ছে দলটি।

সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের (৩)(খ) অনুযায়ী রূপরেখা তৈরি করেছে ঐক্যফ্রন্ট। সংবিধানের (৩)(খ) অনুযায়ী, ‘মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনও কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে :তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন সমকালকে বলেন, সংবিধানের মধ্য থেকেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের একাধিক পথ রয়েছে। সীমিত পরিসরে সংলাপে তারা সংবিধানের কাঠামোর মধ্যেই সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে রূপরেখা দেবেন। তবে রূপরেখায় কী আছে- তা এখন বলা যাবে না।

সরকারের সঙ্গে সংলাপে সুষ্ঠু নির্বাচনের রূপরেখা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আগাম প্রকাশ্য মুখ খুলতে রাজি নন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। তবে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম কয়েকজন শীর্ষ নেতা সমকালকে জানান, বর্তমানে সংবিধান সংশোধন ছাড়া সাংবিধানিক কাঠামোয় নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুযোগ নেই। সংবিধান সংশোধন করে বাদ দেওয়া নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি আওয়ামী লীগ সহজে পুনর্বহাল করবে না। গণবিস্ম্ফোরণ ছাড়া সরকার নিজের পাস করা আইন বাতিল করবে না। অতীতে জনবিস্ম্ফোরণ ও সহিংস আন্দোলনের কাছে মাথানত করে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়েছিল। বর্তমানে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয়ভাবে কঠোর অবস্থানের মুখে জনগণের সমর্থন থাকলেও রাস্তায় দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নামিয়ে দেশ অচল করে দাবি আদায় করা কঠিন বলে তারা মনে করেন।

ঐক্যফ্রন্ট নেতারা জানান, আন্দোলনের নামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে ‘তৃতীয় পক্ষ’ সুযোগ নিতে পারে। তারা চান না, কেউ ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করুক। আর বদনামের ভাগিদার হোক প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট। দেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিএনপিকে বুঝিয়ে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও সমঝোতায় পৌঁছাতে চায় ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিক দলগুলো। একই সঙ্গে তারা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ চারটি মন্ত্রণালয় বিরোধী জোটকে দিলে সারাদেশে একটি ইতিবাচক নির্বাচনী বার্তা পৌঁছে যাবে। যাতে প্রশাসনসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাই নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চিন্তা করবে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজেও বারবার বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তার ওপর আস্থা রাখতে। এসব হিসাব-নিকাশ কষে তারা অন্য দাবিগুলোর বিষয়ে সরকারের আশ্বাসের ওপরই ভরসা রাখতে চান।

সূত্র আরও জানায়, কয়েক দিন ধরে সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে এ রূপরেখার খসড়া তৈরি করে নবগঠিত জোটটি। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতিঝিলের চেম্বারে ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে রূপরেখার খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। এর আগে গতকাল বিকেলে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের চেম্বারে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা এক দফা বৈঠক করেন। বৈঠকে গণফোরামের মহাসচিব মোস্তফা মহসিন মন্টু, ড. শাহ্‌দীন মালিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। রোববার রাতেও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের চেম্বারে তারা বৈঠক করেন।

সূত্র আরও জানায়, ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবির একটি হচ্ছে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। এ দাবির সপক্ষে আইনগত ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণের জন্য কয়েক দিন ধরে ঐক্যফ্রন্ট ও আইনজীবী প্যানেলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বৈঠক চলছে। যেখানে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলছে, সংসদ ভেঙে নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। এ পরিস্থিতিতে সংবিধান ও আইনের ভিত্তিতে সাত দফার বিভিন্ন দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা হয়।

এসব বৈঠকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাস্তবসম্মত ও সংবিধানের মধ্য থেকেই সুষ্ঠু নির্বাচনের ফর্মুলা তৈরি করেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সংবিধানের মধ্যেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব বলে মনে করেন আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তারা সংবিধানের মধ্য থেকেই কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তা দ্বিতীয় দফা সংলাপে তুলে ধরবেন। তবে কী রূপরেখা দেবেন, তা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

ঐক্যফ্রন্টের এক নেতা সমকালকে বলেন, দ্বিতীয় দফা সংলাপ ইতিবাচক। এবারের বৈঠকটি সীমিত পরিসরে হবে। এখানে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের পাশাপাশি সংবিধান বিশেষজ্ঞ দু’জনকে রাখতে চাইবেন তারা। যেহেতু আইন ও সংবিধান নিয়ে আলোচনা হবে, তাই আইনবিদদের রেখে সংলাপ করতে চান তারা। সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট তাদের দাবিগুলোর সাংবিধানিক ও আইনগত যৌক্তিকতা তুলে ধরবে। সিদ্ধান্তের ভার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপরই ছেড়ে দেওয়া হবে। সরকারি দলকেও তারা দু’জন সংবিধান ও আইনবিদ রাখার অনুরোধ করবেন।

ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা ঐক্যজোটের এক নেতা জানান, সরকারকে এটা জানানো যে সংবিধানের মধ্য থেকে নির্বাচনের অনেক উপায় আছে, যা নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ করতে এবং সব রাজনৈতিক দলের আস্থা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। কেননা সরকার বলছে, সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো পন্থা বের করা বা সংবিধান সংশোধন তারা করবেন না।

ঐক্যফ্রন্টের নেতারা আরও জানান, সংবিধানের মধ্য থেকেই তারা সমাধানে জোর দিচ্ছেন। এ কারণে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের কথা বলা হবে। এটি সংবিধানে সুস্পষ্ট বলা আছে। সে ক্ষেত্রে সংসদ ভেঙে দিলে বর্তমান সরকারই অন্তর্বর্তী সময়ে দায়িত্ব পালন করবে। সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রিসভার সদস্যদের এক-দশমাংশ টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী রাখা যায়। বর্তমান মন্ত্রিসভায় ৫০ জনের মতো সদস্য আছেন, অর্থাৎ পাঁচজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী রাখা যায়। এই মন্ত্রীদের ঐক্যফ্রন্ট বা বিরোধীদের থেকে নিতে হবে এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয় দিতে হবে।

ঐক্যফ্রন্টের রূপরেখা তৈরির ব্যাপারে অন্যতম পরামর্শক হলেন বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্‌দীন মালিক। তিনি সমকালকে বলেন, ‘সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। কারণ, সংবিধানে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের বিষয় বলা আছে। আবার সংসদ ভেঙে দিলে পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো কী হবে, তাও সংবিধানে আছে। এ জন্য সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন দেখছি না।’

ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে প্রস্তাব দেওয়া একজন আইনজীবী জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়টি আদালতের ব্যাপার। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ যদি তার জামিনের বিরোধিতা না করে বা আপিলে সাজা স্থগিতের বিরোধিতা না করে, তাহলে ভোটের সময় খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব এবং তার ভোটে অংশগ্রহণও নিশ্চিত হয়। অতীতে এ ধরনের নজির রয়েছে।

প্রথম সংলাপে সভা-সমাবেশ করা, বিদেশি পর্যবেক্ষক আসার বিষয়টি মেনে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর গায়েবি মামলার বিষয়টি তালিকা দেওয়ার কথা বলেছেন। এ ছাড়া সংবিধানবহির্ভূত দাবিগুলো এবং সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছিলেন।

যেসব দাবিকে গুরুত্ব দেবে না ঐক্যফ্রন্ট :নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দেওয়া; বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, সামাজিক গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের অভিযোগে দায়ের মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারদের মুক্তি দেওয়া এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা।

নির্বাচনের ১০ দিন আগে থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া। নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে তাদের ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ না করা এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা। তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা এবং নতুন কোনো মামলা না দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া- এ দাবিগুলো গুরুত্ব দেবে না ঐক্যফ্রন্ট।

সূত্র : সমকাল, ৬ নভেম্বর ২০১৮

Similar Posts

error: Content is protected !!