মস্তিষ্কের জিপিএস ব্যবস্থা উদ্ভাবন

মোবাইলের জিপিএস ব্যবস্থার মতো কিছু কি আছে আমাদের শরীরে? এ রহস্যের উত্তর খুঁজতে চলতি বছর শারীরবিদ্যায় নোবেল পেলেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত মার্কিন গবেষক অধ্যাপক জন ও’কিফি এবং নরওয়েজিয়ান দম্পতি এডভার্ড আই মোসের ও মে-ব্রিট মোসের। মস্তিষ্কের ভেতরকার জিপিএস ব্যবস্থা উদ্ভাবনের জন্য বিশ্বের সম্মানিত ওই পুরস্কারে ভূষিত করা হয় এই তিন স্নায়ুবিজ্ঞানীকে। বিস্তারিত নিয়ে লিখেছেন নাজমুল হোসেন

জন ও’কিফি বর্তমানে কাজ করছেন লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে। তিনি তার গবেষণার প্রথম অংশটি শেষ করেন সেই ১৯৭১ সালে। ওই গবেষণায় তিনি দেখতে পান, ইঁদুর যখন ঘরের এক অংশে থাকে, তখন তার মস্তিষ্কের একটি অংশ উদ্দীপ্ত হয়। আর ঘরের অন্য কোথাও থাকলে উদ্দীপ্ত হয় মস্তিষ্কের ভিন্ন একটি অংশ। এ থেকে ও’কিফির ধারণা হয়, আমাদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে মস্তিষ্কে একটি মানচিত্র তৈরি হয়, যা আমাদের চলাফেরায়ও সাহায্য করে। তিনি এর নাম দেন ‘স্পেইস সেল’। পরে ২০০৫ সালে গবেষক দম্পতি মে-ব্রিট ও এডভার্ড মস্তিষ্কের অন্য একটি অংশ খুঁজে বের করেন, যা অনেকটা সমুদ্রগামী জাহাজের মানচিত্রের মতো কাজ করে। এই অংশ আমাদের আশপাশের বিভিন্ন বস্তু ও সেগুলোর দূরত্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়।
ফলে কোন দিকে কিভাবে যেতে হবে তা আমরা বুঝতে পারি। দুই বিজ্ঞানী এর নাম দেন ‘গ্রিড সেল’। এই স্পেইস ও গ্রিড সেল যৌথভাবে আমাদের মস্তিষ্কে একটি ‘পজিশনিং সিস্টেম’ বা ‘জিপিএস’ হিসেবে কাজ করে। আলঝেইমার বা স্মৃতি লোপ পাওয়ার মতো রোগের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের এই জিপিএস ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে রোগী তার আশপাশের পরিবেশ চিনতে পারে না।
সহজ কথায়, আমরা কোথায় অবস্থান করছি, কিভাবে মস্তিষ্ক তা জানতে পরে এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা ও পরিচালনা মস্তিষ্ক কিভাবে করে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন নোবেল পাওয়া এই তিন স্নায়ুবিজ্ঞানী। নোবেল কর্তৃপ জানিয়েছে, এই উদ্ভাবন আগামী দিনে দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের শতাব্দীকালের সমস্যার সমাধানে সহায়তা করবে। শত বছর ধরে দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা যে সমস্যার উত্তর খুঁজছেন তারই সমাধান করেছেন এই তিনজন। মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর থাকা ‘ইনার জিপিএস’ বা অভ্যন্তরীণ ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবস্থার রহস্য খুঁজে বের করতে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা চালিয়ে আসছিলেন তারা। মানবমস্তিষ্ক কিভাবে কোনো শূন্যস্থানের ভেতরেও দিক নির্ণয় করতে পারে, তা-ই ছিল গবেষণার মূল বিষয়। আলঝেইমার রোগীরা কেন তাদের চার পাশের পরিবেশ চিনতে পারেন না, তা বুঝতে এই তিন বিজ্ঞানীর গবেষণা পথ দেখাবে বলেও আশা প্রকাশ করেছে নোবেল কমিটি।
তাদের গবেষণার ফলে আমরা কোথায় আছি এবং এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিজেদের পরিচালিত করার এ দুই ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে, তা অনুধাবন করার ক্ষেত্রে অর্জিত হলো বিশাল সফলতা। তাদের এ গবেষণার ফল স্মৃতিভ্রংশ রোগ বা আলঝেইমারসের গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে বলে মনে করছেন নোবেল পুরস্কারের জুরি কমিটির সদস্যরা।
দ্য ইনার জিপিএস নিয়ে গবেষণার সফলতা নোবেল এনে দিতে পারে, এমনটি ভাবতেই পারেননি মে-ব্রিট। প্রাপ্তির এই আনন্দদায়ক খবর তার কাছে অনেকটা শকের মতোই মনে হয়েছিল বলে জানান তিনি।
মস্তিষ্কে হিপোক্যাম্পাস অঞ্চল, যা প্রধানত কোন জিনিস কোথায় রয়েছে, সে বিষয়ে মস্তিষ্ককে ইঙ্গিত দেয়, এর ওপরেই গবেষণা চালানোর দীর্ঘ তিন দশক পর একটি সূত্র খুঁজে পান নরওয়ের দম্পতি এডভার্ড ও মে-ব্রিট। স্নায়ুতন্ত্রের অদৃশ্য ‘পজিশনিং সিস্টেম’ চালনাকারী ‘গ্রিড সেল’ নামে একটি কোষের হদিস পান তারা। এ গবেষণায় কোনো একটি শূন্য ঘরের ভেতরেও একটি ইঁদুরের উপস্থিতি কিভাবে মানবমস্তিষ্ক নির্ণয় করে, তার ওপর কাজ চালাচ্ছিলেন তারা। মস্তিষ্কের যেসব কোষ এ অবস্থান খুঁজে পেতে সাহায্য করে, তাদের ‘প্লেস সেল’ বা অবস্থান নির্ণায়ক কোষ বলে উল্লেখ করেছেন গবেষকেরা। এসব কোষের সাহায্যেই শূন্য কোনো স্থানেও কোনো বস্তুর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পেতে সম হয় মানুষ। তার সাহায্যেই মস্তিষ্কে কোনো বস্তুর অবস্থান সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ছবি আঁকা হয়ে যায়।

দ্য ইনার জিপিএস কী?
শারীরবৃত্তীয় মনোবিজ্ঞানের গবেষক জন ও’কিফি ইঁদুরকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দিয়ে দেখলেন, যখন কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় ইঁদুরটি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তখন মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের কিছু কোষ উজ্জীবিত হচ্ছে। আবার ইঁদুরটি যখন অন্য জায়গায়, তখন উজ্জীবিত হচ্ছে সেই হিপোক্যাম্পাসেরই অন্য অংশের কোষ। এর থেকে তার ধারণা হয়, জায়গা বদলের কথা মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোষে জমা হচ্ছে। কোষগুলোর নাম দিলেন তিনি ‘প্লেস সেল’। এবং জানালেন, এভাবে মস্তিষ্কে শুধু তথ্য জমাই হয় না, একই সাথে পারিপার্শ্বিকের মানচিত্রও সেখানে তৈরি হয়। আসলে প্লেস সেলের বিভিন্ন সমন্বয়ে তৈরি হয় প্রতিটি মানচিত্র।
এরপর ২০০৫ সালে গবেষক দম্পতি মে-ব্রিট ও এডভার্ড মোসের আবারো ইঁদুরের ওপরে পরীক্ষা করেন। তারা দেখলেন ইঁদুর যখন কোনো নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের কাছেই এন্টোরহিন্যাল কর্টেক্সের একটি অংশ উজ্জীবিত হচ্ছে। এন্টোরহিন্যাল কর্টেক্সের এই উজ্জীবিত অংশগুলো ষড়ভুজ গঠন করছে। একে গ্রিড বলে। তারা এর নাম দিলেন ‘গ্রিড সেল’। প্রতিটি গ্রিড সেল ইঁদুরের চলাফেরার একটি নির্দিষ্ট পথকে চিহ্নিত করে। এই প্লেস সেল আর গ্রিড সেল মিলিতভাবে প্রাণীদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে।
নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য বাবদ ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনারের মধ্যে এক ভাগ পাবেন আমেরিকা ও ব্রিটেনের যৌথ নাগরিক জন ও’কিফি। তিনি এখন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের ‘সাইনসবুরি ওয়েসকাম সেন্টার ইন নিউর‌্যাল সার্কিটস অ্যান্ড বিহেভিয়র’-এর ডিরেক্টর। অন্য ভাগ পেলেন নরওয়ের মোসের দম্পতি। এর মধ্যে মে-ব্রিট মোসের এখন ট্রন্ডহেইমের ‘সেন্টার ফর নিউর‌্যাল কম্পিউটেশন’ ডিরেক্টর। তার স্বামী এডভার্ড মোসের ট্রন্ডহেইমেরই ‘কাভিল ইনস্টিটিউট ফর সিস্টেমস নিউরোসায়েন্স’-এর ডিরেক্টর। আগামী ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হবে।

 

জন ও’কিফি

জন ও’কিফি
১৯৩৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন জন ও’কিফি। বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের স্নায়ুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও অ্যানাটমি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন- দুই দেশেরই নাগরিক। ও’কিফি ১৯৭১ সালে প্রথম মস্তিষ্কের ‘অভ্যন্তরীণ পজিশনিং ব্যবস্থা’ উদ্ভাবন করেন। গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, কোনো কক্ষে একটি ইঁদুর অবস্থানকালে মস্তিষ্কের একদল কোষ সক্রিয় হয়। কিন্তু অন্য স্থানে যাওয়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কের অন্য একদল কোষ সক্রিয় হয়ে ওঠে।

 

 

এডভার্ড আই মোসের ও মে-ব্রিট মোসের

এডভার্ড আই মোসের ও মে-ব্রিট মোসের
১৯৬২ সালে নরওয়ের অ্যালেসান্ডে জন্মগ্রহণ করেন এডভার্ড। মে-ব্রিটের জন্ম ১৯৬৩ সালে নরওয়ের ফসনাভাগ শহরে। নরওয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী দম্পতি এডভার্ড মোসের ও মে-ব্রিট মোসের কর্মজীবনের শুরু থেকেই কাজ করছেন যৌথভাবে। বর্তমানে তারা নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কেভিল ইনস্টিটিউট ফর সিস্টেম নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড সেন্টার ফর বায়োলজি অব মেমোরির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।

 

 

 
সূত্র : নয়া দিগন্ত অনলাইন

Similar Posts

error: Content is protected !!