নিকলীর “শিক্ষার দূত” জ্ঞানতাপস আবদুল হামিদ

লিবিয়া থেকে সবে দেশে ফিরেছেন। রাতটা কোনরকম বাড়িতে সকালেই পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে হাতে তসবীহ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন গাঁয়ের পথে। ঘুরতে ঘুরতে সোয়াইজনী নদীর গরুছাড়া ঘাট। নৌকার মাঝি ইদ্রিস আলী স্যারকে দেখে প্রথমে চিনতে না পারলেও পরক্ষণেই সালাম দিয়ে নৌকা থেকে নেমে কাচুমাচু হয়ে স্যারের সামনে দাঁড়ালেন।

স্যার একটু বিড়বিড় করে তসবীহতে চুমু দিয়ে সামান্য তোতলাতে তোতলাতে ইদ্রিস আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি-রে, তোর ছেলেটার পড়াশোনা নাকি বন্ধ কইরা দিছস?” কাচুমাচু ইদ্রিস আলী মাথা চুলকাতে চুলকাতে জবাব দেয়, “কি করাম স্যার, একলা আর গুদারাডা টানতাম পারি না। সংসারে অভাব। তাই ছেড়াডারে আর পড়াইতাম পারতাছি না।”

স্যার একটু অনুশাসনের সুরে বললেন, সংসারে অভাব হইলে নৌকাডা বেইচ্ছা দে। সেই টাকা দিয়া ছেড়াডারে পড়া! কামে লাগবো। স্যারের কথার জবাব দিতে পারে না ইদ্রিস আলী। তবুও যতটা সম্ভব স্যারকে তার সমস্যার কথাটা বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু স্যার কোনক্রমেই মেধাবী ছেলেটার ঝরে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি।

অবশেষে ঠিক হলো স্যার নিজেই কিনে নিবেন ইদ্রিস আলীর নৌকাটি, তবে ভাড়ায় চালাবেন ইদ্রিস আলী। শর্ত হলো, ইদ্রিস আলীর ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে হবে। নৌকার দাম বাজারমূল্যে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা হলেও স্যার ইদ্রিস আলীকে নগদ ৫ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিনে পয়সায় ইদ্রিস আলীর কাছে নৌকা ভাড়া দিয়ে ছুটলেন অন্য কোন ইদ্রিস আলীর খোঁজে।

এমন একটা-দুটো নয়। হাজার হাজার উদাহরণ রয়েছে তাঁর জীবনে। তিনি জ্ঞানতাপস আবদুল হামিদ। নিকলীর শিক্ষাকাশে সূর্যের মতো প্রজ্জ্বলিত একটি নাম। যিনি রেখে গেছেন অসংখ্য গুণগ্রাহী এবং অগণিত ভক্ত-ছাত্র।

আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত জনপদ নিকলী উপজেলা সদরের পুকুরপাড় গ্রামে ১৯২৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কারার এন্তাজ উদ্দিন ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। তাঁর এক মেয়ে এক ছেলের সংসারে আবদুল হামিদ ছিলেন ছোট।

তিনি ১৯৪৬ সালে নিকলী গোরাচাঁদ পাইলট হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৮ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টার মিডিয়েট পাশ করেন। গুরুদয়াল কলেজ থেকেই ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় বিভাগে বিএ পাশ করেন। এছাড়া ১৯৫৫ সালে বিএড এবং ১৯৬৪ সালে এমএড পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।

নিকলী গোরাচাঁদ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়েই তিনি শুরু করেন তার কর্মজীবন। ব্যয় নির্বাহে এ প্রতিষ্ঠানটি যখন বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে তখন তিনি পরিচালনা পরিষদের কাছ থেকে বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব চেয়ে নেন। শিক্ষার আলো ছড়াতে বিসর্জন দেন নিজের জীবনের সকল চাওয়া-পাওয়াকে। বিদ্যালয়ের ব্যয় মেটাতে সমমনা কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান সংগ্রহ শুরু করেন।

হাজারো প্রতিকূলতায় স্কুলটিকে টেনে নিতে একসময় সঙ্গীরা হাঁফিয়ে উঠেন, কয়েকজন ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। অকুতোভয় আবদুল হামিদ তেলের পিদিমের মতো জ্বলে যান নিভু নিভু। অবশেষে সফররত তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী হামিদ উদ্দিনের সহযোগিতায় পাট কোম্পানীগুলি থেকে স্কুলের জন্য মণপ্রতি ২ পয়সা অনুদান বরাদ্দ পান।

এ সময় সারাদিন স্কুলে কর্মব্যস্ততা শেষে রাতে হারিকেন হাতে আবদুল হামিদ স্যার ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি ছুটেছেন বছরের পর বছর। স্কুলের বাইরে দৈনন্দিন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, সমস্যা সমাধান করে স্কুলমুখী করেছেন ছাত্রদের। ছাত্রদের অভিভাবকদের সাথেও তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। দূর-দূরান্তের ছাত্রদের জায়গীরের ব্যবস্থা করতে ঘুরেছেন বিত্তশালীদের দ্বারে দ্বারে।

ইংরেজি, গণিত ও আরবী ভাষার উপর তাঁর ছিলো বিশেষ দক্ষতা। অক্লান্ত শ্রম, মেধা দিয়ে নিজ হাতে গড়েছেন উচ্চপদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। গড়েছেন বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের মতো সফল রাজনীতিকও।

১৯৭২ সালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট হাইস্কুলে ২ বছর প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি ফের নিকলী হাইস্কুলের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৮ সালে দু’ভাষী হিসেবে চলে যান হিসাবে সৌদি আরব। ফিরে এসে গড়ে তোলেন “আদর্শ কুঁড়ি” নামের একটি অত্যাধুনিক শিশু বিদ্যালয়।

আশির দশকে কিশোরগঞ্জের আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে দু’বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে ৯০ এর দশকে আবারও চলে যান বাংলাদেশ কমিউনিটি স্কুলের প্রিন্সিপাল হিসাবে লিবিয়ার ত্রিপলীতে।

দেশে ফিরে যেখানেই দেখেছেন শিক্ষার বৈরী পরিবেশ সেখানেই জীবনের সঞ্চিত অর্থে ফিরিয়েছেন অনুকূলতা। শিক্ষার পরিবেশ তৈরি, সুবিধা বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। নিজের বা পরিবারের দিকে তাকাবার প্রয়োজন মনে করেননি।

জীবনের অন্তিম দশায় নানাবিধ রোগে ভুগে ২০০৪ সালের ২১ জুলাই নিকলী সদরের বানিয়াহাটি নিজ বাড়িতে ৭৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান শিক্ষাবিদ।

অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত জ্ঞানতাপস আবদুল হামিদ এতটাই শিক্ষা পাগল ছিলেন যে, নিজের ব্যক্তিগত চিন্তা কখনোই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। নিজের চার ছেলে, পাঁচ মেয়ের জন্যে একটি মাত্র বাড়ি রেখে যেতে পারলেও শত নিরন্নের জন্য করেছিলেন অন্নের ব্যবস্থা।

শত ঘরহীনের আকাশচুম্বী স্বপের সিঁড়ি করে দিয়েছিলেন রচনা। তিনি ছিলেন মানুষের, করা-গড়া সব কিছু মানুষের জন্যেই তাঁর। হাওরের প্রত্যন্ত জনপদ নিকলীর এই আলোকবর্তিকা আবদুল হামিদ চির ভাস্বর, চির উজ্জ্বল একটি নাম।

[লেখাটি ২০১৯ সালের ২২ জুলাই হেডমাস্টার স্যারের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে “কিশোরগঞ্জ নিউজ” অনলাইনে প্রকাশিত]

Similar Posts

error: Content is protected !!