মাইকেল জ্যাকসন : অপার রহস্যের এক আধার

পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন, তাদের জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পর একই রকম জনপ্রিয় ও রহস্যময়। কিন্তু মাইকেল জ্যাকসন ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫০ বছর। আর এ ৫০ বছরের জীবনেই তিনি বেঁচেছিলেন রাজার মতো। যখন যা ইচ্ছে করেছেন। বিলাসবহুল বাংলো, নিজস্ব চিড়িয়াখানা, প্রাইভেট বিমান, দামি ব্র্যান্ডের ডজন ডজন গাড়ি, জমকালো পোশাক-আশাক, অলঙ্কার। কী ছিল না তার জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে। গানের বিশ্ব শাসন করেছেন মহারাজের মতো। তাই তো সারা বিশ্ব তাকে এক নামে ডাকে ‘কিং অব পপ’। এই শিল্পী ছিলেন এক কথায় তারকাদের তারকা, পৃথিবীর তাবত তারকা শিল্পী যার ভক্ত। সেই মানুষটির হঠাৎ মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি তার ভক্তরা। সবার মনেই প্রশ্ন জেগেছে- এটি কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু? নাকি পরিকল্পিত কোনো হত্যা? এমন প্রশ্ন খুব কম সময়েই ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর লাখো লাখো ভক্তের মনে। এই ছোট প্রশ্নগুলো জমা হয়েই জ্যাকসন মৃত্যু নিয়ে আজ তৈরি হয়েছে এক ধোঁয়াটে পরিস্থিতির। প্রতিটি ধোঁয়ার পেছনেই আগুন থাকে। জ্যাকসনের মৃত্যুর পেছনেও হয়তো রয়েছে কারো না কারো কালো হাত। ব্যক্তিগত চিকিৎসক, গৃহভৃত্য, অ্যালবামের প্রযোজক থেকে শুরু করে জ্যাকসনের ওয়ার্ল্ড ট্যুরের আয়োজক কোম্পানি কেউই বাদ যাচ্ছে না সন্দেহের তালিকা থেকে। মাইকেল জ্যাকসনের পারিবারিক বন্ধু টেরি হার্ফে বলেন, মাইকেলের মৃতদেহের ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, ব্যথানাশক ইনজেকশন ডিপ্রিভান মাত্রাতিরিক্ত নেয়ার কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। তার গলা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে সুইয়ের চিহ্ন ছিল।

michael-jackson
এ ছাড়া মাইকেলের পেটে বড়ির স্তরও পাওয়া গেছে। ছিলেন মাইকেল জ্যাকসনের প্রিয় বোন। মৃত্যুর পরপরই পপ সম্রাটের বাড়ি থেকে প্রচুর পরিমাণে ডিপ্রিভান, শিরাপথে স্যালাইন দেয়ার স্ট্যান্ড ও অক্সিজেন ট্যাক পাওয়া যায়। জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ই জ্যানেটের দারস্থ হয়েছেন জ্যাকসন। সেই জ্যানেটই ঘোষণা দিয়েছেন, যেকোনো কিছুর বিনিময়েই হোক, তিনি মাইকেলের মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করেই ছাড়বেন। জ্যানেটের অভিযোগ, মাইকেল জ্যাকসন মৃত্যুর ফলে যারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন বা হচ্ছেন, তারাই তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছেন। অর্থাৎ জ্যাকসনের মৃত্যু যে মোটেই স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, সে বিষয়ে তিনি জোর মতামত ব্যক্ত করেছেন।
মৃত্যুর সাথে সাথে মাইকেল জ্যাকসনের গাওয়া গানের অ্যালবামগুলো হু হু করে টপচার্ট দখল করে নিয়েছে। ভক্তরা তার গানের অ্যালবাম কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। ফলে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করছে অডিও প্রযোজনা সংস্থাগুলো। জ্যানেটের অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তবে এই অডিও ব্যবসায়ীরাই তার সন্দেহের তালিকায় প্রথম স্থান পাবে। কারণ জ্যাকসন মারা যাওয়ার পর এই শ্রেণীই সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করছে।
জ্যানেটের দাবি, মাইকেলের বাসায় সব সময়ই কমপে ২০ লাখ ডলার ক্যাশ থাকত। জ্যাকসন তার দৈনন্দিন জীবনের খরচ মেটাতে এ পরিমাণ অর্থ বাসায়ই রাখতেন। শুধু তা-ই নয়, কোটি কোটি ডলার মূল্যমানের হিরা-জহরত খচিত গয়না ও পাথরেও নাকি জ্যাকসনের বাসা ছিল ভরপুর। মৃত্যুর পর তার কিছুই পাওয়া যায়নি। যে বাড়িতে জ্যাকসনের মৃত্যু হয়েছে, সেটি ছিল একেবারেই শূন্য একটি বাড়ি। জ্যানেট জানান, ‘আমার ভাই কখনোই এমন শূন্য হাতে দিন কাটাতে পারে না। তার সব গচ্ছিত সম্পদ লুট করা হয়েছে। আর এ লুটের সাথেও তার মৃত্যুর সম্পর্ক রয়েছে।’ জ্যানেটের এ সন্দেহও যদি সত্যি হয়, তাহলে এবার অভিযুক্তদের তালিকায় যোগ হবে তার কাছের মানুষজন। সব সময় মাইকেল জ্যাকসনের কাছে থাকতেন তার ম্যানেজার, চিকিৎসক, আইনজীবী ও গৃহপরিচারিকারা।
কিভাবে জ্যাকসনকে মেরে ফেলা হয়েছে তার একটি ধারণাও দিয়েছেন জ্যানেট। তার ভাষ্যমতে, শত্র“দের পরিকল্পিত এবং দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফল জ্যাকসনের মৃত্যু। শত্র“রা অর্থের লোভে দীর্ঘদিন ধরেই জ্যাকসনের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলার চেষ্টা করে আসছিল। বিভিন্নভাবে তারা সার্থকও হয়েছিল। ফলে জ্যাকসন বেছে নিয়েছিলেন নির্জন বাস আর ওষুধের আশ্রয়। এভাবেই দিনের পর দিন অস্বাভাবিক জীবনযাপনের ফলে জ্যাকসন হয়ে পড়েছিলেন কর্মহীন। হারিয়ে ফেলেছিলেন আত্মবিশ্বাস। ফলে আরো বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন ওষুধের ওপর। এ ব্যাপারে তাকে প্রভাবিত করেছিল একটি চক্র। চক্রটি অবশেষে সফলতা লাভ করে জ্যাকসনের মৃত্যু ঘটিয়ে এবং মৃত্যুরহস্য ধামাচাপা দিতে পেরে।
জ্যানেটের দাবি, মৃত্যুর কিছু দিন আগেই মাইকেল তার বিপদের কথা প্রিয় বোনের কাছে বলেছিলেন। মৃত্যুর কয়েক দিন পরই লন্ডনের কনসার্টটিও একটি সাজানো নাটক বলে দাবি জ্যানেট জ্যাকসনের।
জ্যাকসনের মৃত্যু কি স্বাভাবিক? প্রশ্নটিকে আরো বেশি জোরালো করে তোলে জ্যাকসনের দেহাবশেষ যে কফিনে রাখা হয়েছিল, সেই কফিনের অযৌক্তিক নিরাপত্তায়। জ্যাকসেনের এক ভাই বলেন,, কফিনে মাইকেলের মৃতদেহ ছিল না, ছিল দেহ পোড়ানো ছাই। সাত-তাড়াতাড়ি দেহটি পুড়িয়ে জ্যাকসনের মৃত্যুরহস্য ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন কেউ কেউ, এ অভিযোগ তাহলে তোলাই যায়।
সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাাৎকারে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু মন্তব্যও করেছেন জ্যানেট। মাইকেল জ্যাকসনের পারিবারিক বন্ধু টেরি হার্ভে বলেন, মাইকেলের মৃতদেহের ময়নাতদন্তে দেখা গেছে ব্যথানাশক ইনজেকশন ডিপ্রিভান মাত্রাতিরিক্ত নেয়ার কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। তার গলা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে সুইয়ের চিহ্ন ছিল। এ ছাড়া মাইকেলের পেটে বড়ির স্তরও পাওয়া গেছে। মৃত্যুর পরপরই পপ সম্রাটের বাড়ি থেকে প্রচুর পরিমাণে ডিপ্রিভান, শিরাপথে স্যালাইন দেয়ার স্ট্যান্ড ও অক্সিজেন ট্যাক পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে পুলিশ শিগগিরই এক বা একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলবে। ট্যাবলয়েড পত্রিকা নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড তাদের খবরে বলেছে, অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য মাইকেলের পরিবার কী নিয়ে কাজ করছে ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। আর লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ বিভাগ ওই চিকিৎসকদের খুঁজছে যারা মাইকেলকে এ ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে এবং এটি গ্রহণে তাকে সহায়তা করেছে ও এই ইনজেকশন তার কাছে সহজলভ্য করে তুলেছে। এ দিকে মাইকেল জ্যাকসনের চিকিৎসক কনরাড মুরের টেক্সাসের কিনিকে অভিযান চালিয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ। জ্যাকসন পরিবারের মতো পুলিশেরও এখন সন্দেহ প্রাণঘাতী হতে পারে এমন ওষুধ সেবনই মাইকেলের মৃত্যু হতে পারে। কনরাড মুরে পপ সম্রাটের মৃত্যুর দিনেও তাকে চিকিৎসা দিয়েছিলেন।
জ্যাকসন পরিবারের অভিযোগ- মুরে ওই দিন রহস্যজনক আচরণ করছিলেন। কিনিকে অভিযানের দিন কনরাড মুরে কিনিকে ছিলেন না। তিনি লাস ভেগাসে বিশেষ কাজে গিয়েছিলেন। পপ সম্রাটের মৃত্যুর পর থেকে তিনি ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না বলে দাবি করেছে মুরের আইনজীবী। কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্তে পপ সম্রাটের চিকিৎসার ব্যাপারে নেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে জ্যাকসনের পরিবারের সাথে কনরাড মুরের মতপার্থক্যও জোরালো হচ্ছে দিন দিন। এ দিকে বিভিন্ন সময়ে জ্যাকসনকে চিকিৎসা দেয়া নয় চিকিৎসকের ব্যাপারেও খোঁজখবর নিচ্ছে পুলিশ। ফক্স নিউজ জানায়, চিকিৎসার নামে মাদকের এবং অতিরিক্ত ব্যথানাশক ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিলেন যেসব চিকিৎসক, তাদের ওপর এখনো রয়েছে পুলিশের কড়া নজরদারি। ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক, নেভাডা, টেক্সাস ও ফোরিডার এ নয়জন চিকিৎসক বিভিন্ন সময় জ্যাকসনকে চিকিৎসা দেন। সম্প্রতি মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল এবিসি নেটওয়ার্ক পপ সম্রাটের একটি ভিডিওচিত্র প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, জ্যাকসনের পায়ে বিভিন্ন স্থানে কালো ক্ষতচিহ্ন। লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ মনে করছে প্রতিনিয়ত গ্রহণ করা এসব মাদক জাতীয় ওষুধই জ্যাকসনকে হত্যা করেছে।
এ দিকে মাইকেল জ্যাকসনের বাবা জো জ্যাকসন জানান, একটানা ৫০টি শো করার জন্য প্রস্তুত ছিল না জ্যাকসন নিজেও। সে মাত্র পাঁচ থেকে দশটি শোতে পারফর্ম করার মতো শারীরিকভাবে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু লন্ডনে এই জি লাইভ শো’র প্রধান আয়োজক র‌্যাডি ফিলিপস একে একে ৫০টি শো’র তারিখ জুড়ে দেন। জ্যাকসনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা লিওনার্দ রোও এই একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুর সাথে কনসার্ট আয়োজক কোম্পানি যারা ইতোমধ্যেই কোটি কোটি ডলারের টিকিট বিক্রি করেছেন, তাদের কোনো হাত রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এ ছাড়া এতগুলো শো তো পারফর্ম করার জন্য রিহার্সেলও শুরু করেছিলেন এই পপ তারকা। এ রিহার্সেল তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে বলেও ধারণা করছে জ্যাকসনের পরিবার।

লেখক : তামিম হাসান, বিনোদন সম্পাদক, নয়া দিগন্ত

সূত্র : অন্য এক দিগন্ত

Similar Posts

error: Content is protected !!