কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী থানাধীন ৭নং ইউনিয়ন ছাতিরচর। প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি গ্রাম। এই গ্রামটি নিকলী উপজেলা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে খরস্রোতা ঘোড়াউত্রা নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত এবং গ্রামটির জন্ম ইতিহাস প্রায় ২০০ (দুইশত) বছর হবে। এ গ্রামে প্রায় পনের হাজার লোকের বসবাস এবং সবাই কৃষিজীবি ও কৃষির উপরই নির্ভরশীল। কৃষিকাজ করে হাজার হাজার টন ধান উৎপন্ন করে দেশের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বিরাট ভূমিকা রাখে।
এই গ্রামের আদিপুরুষগণ নরসিংদী, রায়পুরা, ভৈরব, বেলাব, পাকুন্দিয়া, নারায়ণগঞ্জ থেকে ছাতিরচরে এসে বাতানবাড়ী নির্মাণ করতঃ কৃষিকাজ শুরু করে এবং ক্রমাম্বয়ে গ্রামটি স্থায়ীরূপ ধারণ করে। ২০০৩ ইং সালে ভাটির শার্দূল বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আঃ হামিদ সাহেবের প্রচেষ্টায় ও সহযোগিতায় ছাতিরচর গ্রাম নিকলী উপজেলার ৭নং ইউনিয়নের মর্যাদা লাভ করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত গ্রামটি হাওড়ে অবস্থিত। গ্রামটি দেখার জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার লোক বিভিন্ন মৌসুমে পরিদর্শনে আসে।
ছাতিরচর গ্রাম কয়েকটি পাড়ায় বিভক্ত এবং এই গ্রামে শিক্ষার প্রসার ঘটে আশির দশক হতে। এর আগেও কিছু সংখ্যক ব্যক্তি সামান্য লেখাপড়া করেছেন। এই গ্রামে ৩টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি উচ্চবিদ্যালয়, দুটি মাদ্রাসা, ৭টি মসজিদ, ১টি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়, এনজিও কর্তৃক পরিচালিত ২টি ভাসমান বিদ্যালয়, ১টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং মসজিদভিত্তিক মক্তব ও ১টি বাজার রয়েছে।
গ্রামের অনেক ছেলে মেয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, হাইস্কুল ও মাদ্রাসায় লেখাপড়া করছে। কিছু লোক অতিকষ্টে লেখাপড়া করে। বর্তমানে শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ-বাহিনী, এনজিও কর্মকর্তা, শিল্পী-সাহিত্যিক, কবি, চিত্র পরিচালক, কলেজের প্রভাষক পদে কর্মরত আছে। এছাড়াও ইতালী, ইউরোপের অন্যান্য দেশসহ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরীরত আছেন।
এই গ্রামের শিক্ষা সংস্কৃতি অন্যান্য গ্রামের মতোই। সামাজিক ও জাতীয় আচার অনুষ্ঠান ব্যাপকভাবে পালিত হয়। এই গ্রামের লোকজন সকলেই পারস্পরিক আত্মীয় এবং সুখে দুঃখে পারস্পরিক সহমর্মিতার বন্ধনে আবদ্ধ।
কিশোরগঞ্জ জেলার বিখ্যাত জনসাই হাওড়ে খরস্রোতা ঘোড়াউত্রা নদীর পূর্বপাড়ে উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি অবস্থিত ছাতিরচর। তাই অবস্থানগত কারণে গ্রামটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বর্ষা বা ঝড়ো মৌসুমে সকল জলযানের আশ্রয়স্থল এই গ্রাম এবং চোর ডাকাতের আক্রমণে সকল জলযান বা ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দানে অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে দায়িত্ব পালন করে গ্রামবাসী। শুকনো মৌসুমে হাওড়ে চাষাবাদ করার জন্য আগত লোকদের নিরাপত্তা দেয় গ্রামবাসী। এ ছাড়াও হাওড়-বাওড়, নদী-নালা, খাল-বিল বেষ্টিত এলাকার অভয়ারণ্য বন্য পশুপাখিদের আশ্রয়স্থল এই গ্রাম।
সার্বিক বিবেচনায় উদীয়মান এই গ্রাম বা ইউনিয়ন বিগত কয়েক বৎসর যাবত খরস্রোতা ঘোড়াউত্রা নদীর ভাঙনের ফলে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে গেছে। প্রতি বছর বর্ষাকালে কয়েকশ ঘরবাড়ি ভেঙেই চলে। এই অবস্থা চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে এবং গ্রামবাসী অসহায় অবস্থায় পতিত হবে। নিকলী উপজেলার মানচিত্র থেকেও হয়তো এই ঐতিহ্যবাহী গ্রামটি (বর্তমানে ইউনিয়ন) হারিয়ে যাবে। আর ক্ষয়ে ক্ষয়ে এই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া কোনভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। তাই স্থানীয় বা সরকারীভাবে গৃহীত ছোটখাট উদ্যোগ তেমন কোন কাজে আসছে না। যেহেতু ঘোড়াউত্রা একটি খরস্রোতা নদী; তাই নদীভাঙনের কড়াল গ্রাস থেকে গ্রামটি রক্ষাকল্পে একান্ত দরকার নদী শাসন। বর্তমান সরকার হাওড় ও হাওড়বাসীর উন্নয়নকল্পে ব্যাপকভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। আমরা ছাতিরচরবাসীর প্রস্তাবনা বা আবেদন হল সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট বড়বিল (হাওড় এলাকার নাম) নদী হতে নয়নবালি ফিশারীর পূর্ব দিক দিয়ে শোলাবাড়িয়া চরের পশ্চিম দিকের চিপালিয়া খালের উত্তর মুখ খনন করে নদীর গতি পরিবর্তন করে দিলে ছাতিরচর গ্রামটি চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে একটি নদীর নিকট মানুষ হেরে বা পরাজিত হওয়া কোনক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নদী ভাঙনের কবল হতে ছাতিরচর গ্রামটি (বর্তমানে ইউনিয়ন) রক্ষাকল্পে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন রাখছি।
মোঃ শাহজাহান ইসলাম
এডভোকেট
ছাতিরচর, নিকলী, কিশোরগঞ্জ।