জন্মতারিখ ভুলে ভাতা বন্ধ গুরুইয়ের মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হকের!

বিশেষ প্রতিনিধি ।।

জাতীয় পরিচয়পত্র কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। ভুল বয়স লিপিবদ্ধের কারণে ৩ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। চরম হতাশায় অভাব-অনটনে দিনাতিপাত করছেন নিকলীর সেই মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হক (মুক্তিবার্তা নং-০১১৭০৪০১৯৮)।

জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন ২১ বছরের যুবক বর্তমান নিকলী উপজেলার গুরুই ইউনিয়নের মৃত সাহেব আলীর পুত্র শামসুল হক। থাকতেন ঢাকার লালবাগে। ৭১’র মার্চের শেষে বাড়ি ফেরার পথে ভৈরবে পাকসেনা কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠেন। এলাকার যুবকদের নিয়ে গুটি কয়েক দেশি বন্দুক ভরসা করে গড়ে তোলেন বাহিনী।

খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ জয়লব্ধ অস্ত্র ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় নিজস্ব ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষিত করেন মুক্তিকামীদের। একে একে শতাধিক যুবক নিয়ে বাহিনী প্রধান আবদুল মোতালেব বসুর নামে “বসু বাহিনী” অংশ নেয় দুঃসাহসিক সব অভিযানে। যার সেকেন্ড ইন কমান্ড শামসুল হক। ৬ সেপ্টেম্বর পাক মেজর দুররানি, আসলাম ও ফিরোজের নেতৃত্বে রাজাকারদের সহায়তায় অতর্কিত গুরুই গ্রামে আক্রমণ চালায়। কমপক্ষে ৩০ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। আক্রমণ প্রতিহত করতে গেরিলা কৌশল অবলম্বন করে বসুবাহিনী।

কয়েকজন ব্যস্ত রাখেন আক্রমণকারীদের। সম্পূর্ণ ভিন্ন সাজে একা শামসুল হক বিভিন্ন অবস্থান থেকে ৫ পাক সদস্য ও ১০ রাজাকারকে নির্ভেদ্য গুলিতে নিধন করেন। ২ রাজাকারকে অস্ত্রসহ জীবিত আটক করেন। ১৯ অক্টোবর নিকলী মুক্ত করতে গিয়ে সম্মুখ সমরে হারান মালেক, মতি, নান্টুসহ কয়েক সতীর্থ। শুধু তাই নয়। দেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে স্বাধীনতা বিরোধীদের নজর এড়িয়ে নিরাপদে ভারতের আশ্রয়শিবিরে পৌঁছে দেন দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির অনেকের রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করেন।

২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত ৪৮.০০.০০০০.০০২.১২-৩৪০ পরিপত্রে ২৬.০৩.১৯৭১ ইং তারিখে মুক্তিযোদ্ধার বয়স ১৩ হলে তিনি স্বীকৃত এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতাধীন বলে উল্লেখ করা হয়। শামসুল হকের জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মতারিখ ১৯৫৯ সালের ১ এপ্রিল লেখা রয়েছে। নির্ধারিত তারিখে তাঁর বয়স দাঁড়ায় ১১ বছর ১১ মাস ২৫ দিন। একই বছরের ডিসেম্বর মাসে শামসুল হকের ভাতা প্রদান বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৭ সালের ১২ জুন ৪৮.০০.০০০০.০০২.১২-৩৪০ পরিপত্রের ২৪২ নং স্মারকে (৪) এর উপানুচ্ছেদ ঙ মোতাবেক বয়স যোগ্যতা ১২ বছর ৬ মাসে শিথিল করা হয়। তাতেও হিসাবের বাইরে থাকেন শামসুল হক। সারা দেশের মতো ২০১৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নিকলীতে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশি ট্রেনিংপ্রাপ্ত সত্ত্বেও বসুবাহিনীর অনস্বীকার্য অবদানের জন্য বিশেষ বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের গণ্য করা হয়। কিন্তু শামসুল হক আটকে থাকেন বয়সের ফেরে।

শামসুল হক জানান, অসহায় মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সরকার আমাকে বাড়ি করে দিয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রে আমাকে না জিজ্ঞেস করেই মনগড়া বয়স বসিয়ে দিয়েছিলো। ধরা পড়ে বাছাইয়ে। সংশোধনের জন্যে উপজেলা নির্বাচন কমিশনের দ্বারে ঘুরছি ৩ বছর ধরে। ভাতা বন্ধ। ছেলে-মেয়ে বেকার। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কোথাও আবেদন করতে পারছে না। শেষ বয়সে অভাব আর অপমানের জীবন বড় দুঃসহ!

নিকলী উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্র জানায়, শামসুল হক ভোটার হয়েছেন ঢাকার লালবাগে। ইতিমধ্যে ভোটার এলাকা পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন বয়স সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে।

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইয়াহ হিয়া খান জানান, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা শুনেছি। বিরল অবদান সত্ত্বেও ভুল বয়স লিপিবদ্ধের কারণে তাঁর ভোগান্তি দুঃখজনক। বয়স সংশোধিত হয়ে এলে আমার পক্ষ থেকে যা করণীয় দ্রুত সব করে দেবো।

সূত্র : মানবজমিন, ২০ জুলাই ২০১৮

Similar Posts

error: Content is protected !!