মো: আল আমিন, বিশেষ প্রতিনিধি (কিশোরগঞ্জ) ।।
ঈদের দিন। সময় সকাল পৌনে নয়টা। কিশোরগঞ্জ শহরের প্রতিটি রাস্তা অলিগলিতে জনস্রোত। সবাই শোলাকিয়ার দিকে যাচ্ছেন। ১০টায় শুরু হবে ঈদ জামাত। সে অনুযায়ী চলছে প্রস্তুতি। এর মধ্যেই হঠাৎ দুমদাম বিস্ফোরণের শব্দ।
বিস্ফোরণ হয় মাঠ থেকে দুইশ গজ দূরে আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে, মুফতি মোহাম্মদ আলী মসজিদের সামনের রাস্তায়। ঈদগাহমুখি জনস্রোতের সামনেই এ ঘটনা ঘটায় সন্ত্রাসীরা। সেখানে পুলিশের টহল দল লক্ষ করে বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়ে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার সময় এ স্থানে টহলরত ছিল ১০/১২ জন পুলিশ। বোমার বিস্ফোরণে কয়েক পুলিশ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিছু পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পিছু হটে। এর মধ্যেই মাটিতে পড়ে যাওয়া পুলিশদের চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে দুই সন্ত্রাসী। এ পরিস্থিতিতে পিছু হটে যাওয়া পুলিশ প্রস্তুতি নিয়ে সামনে আসে। সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। সন্ত্রাসীরাও পাল্টা গুলি ছোঁড়া শুরু করে। ঈদগাহমুখি মুসল্লিরা তখন আত্মরক্ষার্থে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মুফতি মোহাম্মদ আলী মসজিদের খতিব মাওলানা মোঃ দ্বীন ইসলাম এ প্রতিনিধিকে জানান, ঘটনার পুরোটা সময় তিনি মসজিদের দোতলায় অবস্থান করছিলেন। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখেন পুলিশদের কোপানো হচ্ছে। মাটিতে পড়ে যাওয়া এক পুলিশ উঠে দাঁড়াতে চাইলে ওই পুলিশকে ঘাড়ের দিকে কোপ দেয়া হয়। পরে তাকে আরো কোপানো হয়। এ সময় এক পুলিশ দৌড়ে এসে মসজিদের ওজুখানায় আশ্রয় নিলে তাকেও কোপানো হয়। পরে তিনি এই পুলিশকে রক্তাক্ত অবস্থায় ওজুখানাতেই পড়ে থাকতে দেখেন।
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী শোলাকিয়া এলাকার মনির হোসেন (২৫) জানান, বন্ধুদের নিয়ে ঈদগাহে যাবেন এই প্রস্তুতিতে মসজিদের ছাদে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এর মধ্যেই বোমার বিকট শব্দ। রাস্তায় মুসল্লিদের ছোটাছুটি। দৌড়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন তিনি। ততক্ষণে পুলিশ আর সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। গোলাগুলির সময় মসজিদের পেছনের সবুজবাগ গলির দিকে ঢুকে পরে সন্ত্রাসীরা। মনির জানান, সেখানে পুলিশ আর সন্ত্রাসীদের মধ্যে ২০/২৫ মিনিটের মতো গোলাগুলি হয়। এক পর্যয়ে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দুই সন্ত্রাসী পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে গলির ভেতরে আওয়ামীলীগ নেতা আবদুল হান্নান ভূঞা বাবুলের বাসার ঘুপচিতে আড়াল নেয়। সেটা তিনি মসজিদের ছাদ থেকে দেখতে পান। পরে তিনি সাহস করে নিচে নেমে এসে পুলিশকে সন্ত্রাসীদের অবস্থান জানান।
বোমা হামলার পর পুলিশ-সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি, পুলিশের গুলিতে এক সন্ত্রাসীর নিহত হওয়া এবং আরেক সন্ত্রাসীকে ধরার পুরো বিষয়টি পাঁচতলার বাসা থেকে প্রত্যক্ষ করেন সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান রেনু। বৃহস্পতিবার মসজিদের সামনে বোমা হামলা গোলাগুলির পর তার বাসার সামনে এসে আবার কয়েক দফা পুলিশ-সন্ত্রাসী গোলাগুলি হয়।
হাফিজুর জানান, ঘুম থেকে উঠে জামাতে যেতে গোসলের প্রস্তুতি নেন তিনি। এমন সময়েই বোমার বিস্ফোরণ, গোলাগুলি। শত শত রাউন্ড গুলি। কান ঝালাপালা অবস্থা। বাসার সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়েন। নিচের কেঁচি গেট লাগিয়ে দেয়া হয়। তিনি বাসার চার তলায় গিয়ে জানালার পাশে অবস্থান নেন। তার বাসার পাশেই বাবুলের বাসার বাইরে ঘুপচিতে দুই সন্ত্রাসী অবস্থান নিয়েছিল। তাদের ধরতেই এই গুলিবিনিময়।
রেনু বলেন, ‘পুলিশ শত শত রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে যখন ঘুপচির দিকে এগিয়ে যায় তখন এক হামলাকারী পুলিশকে লক্ষ করে হাতবোমা নিক্ষেপ করে। ঘুপচির ওপাশে দেয়াল দিয়ে বন্ধ থাকায় দুই হামলাকারী আটকা পড়ে যায়। এক হামলাকারী এ সময় হাতে থাকা চাপাতি ঘুরাতে ঘুরাতে পুলিশকে আক্রমণ করতে আসে। এক পর্যায়ে কিশোরগঞ্জ সদর থানার ওসি (তদন্ত) মুর্শেদ জামানসহ কয়েক পুলিশ একের পর এক গুলি করে চাপাতি হাতে থাকা সন্ত্রাসীকে মাটিতে ফেলে দেয়।’