নববর্ষের আনন্দ নেই হাওরের কৃষকের ঘরে (ভিডিওসহ)

হারুন অল কাইয়ুম ।।

বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় এক-দশমাংশ হাওর এলাকা। যদিও সাতটি জেলা নিয়ে হাওর অঞ্চল বিস্তৃত। তবে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জ- এই তিন গঞ্জের মধ্যেই রয়েছে ৯৫% হাওর। এখানকার ভূ-প্রকৃতি, জনজীবন, কৃষ্টি-সভ্যতা সবকিছুই কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। হাওরের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য- বর্ষাকালে এর যৎসামান্য কিছু ভূমি ছাড়া প্রায় পুরোটাই পানির নীচে তলিয়ে যায়। শুষ্ক মৌসুমে আবার জেগে উঠে। যেখানে জন্মে সোনার ফসল। মুষ্টিমেয় কিছু চাকুরীজীবি ছাড়া এ অঞ্চলের সবাই কৃষিজীবি। শুষ্ক মৌসুমে কৃষি আর বর্ষায় মাছ ধরা এখানকার মানুষের প্রধান পেশা। হাওরাঞ্চলের জনসংখ্যা অনুপাতে এখানে উৎপাদিত সবকিছুই উদ্বৃত্ত। ধান, গম, ভূট্টা, বাদাম, আলুসহ সকল প্রকার কৃষিজাত ফসল ছাড়াও মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি যা কিছু উৎপন্ন হয়। তা এখানকার মানুষের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। তাই এসব জিনিস নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

তাই একথা বলা যায়, এ হাওরাঞ্চলের মানুষেরা অন্যান্য অঞ্চলের মানুষকে বেঁচে থাকতে সহযোগিতা করে। কিন্তু হাওরের মানুষ বেঁচে থাকে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়। তাদের জীবন কাটে প্রকৃতির সাথে নিরন্তর সংগ্রাম করে। গত কিছুদিনের প্রবল বৃষ্টিতে এবং উজান থেকে নেমে আসা পানিতে অকাল বন্যায় তলিয়ে গেছে কৃষষের প্রাণ-স্বপ্নের ধান। সাধারণত চৈত্র মাসে এমন পানি হয় না। অন্তত আরও দেড়-দুই মাস পর, জ্যৈষ্ঠ মাসে এমন পানি হওয়ার কথা। কোথাও কোথাও ফসল রক্ষার জন্য নির্মিত মাটির বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। গ্রামবাসীরা নির্ঘুম পাহারা আর প্রাণান্ত চেষ্টা করেও ফসল রক্ষা করতে পারেনি।

নিকলী উপজেলার বরুলিয়া মৌজার জোয়ানশাহী হাওরে ঘুরে দেখা যায়, সমগ্র এলাকা পানিতে সয়লাব। কোথাও ধান সম্পূর্ণ পানির নীচে তলিয়ে গেছে, কোথাও হাঁটু পানিতে শুধু ধানের শীষটুকু পানির ওপরে ভাসছে। বর্তমানে কেবল বিআর-২৮ জাতের ধান পেকেছে। এছাড়া সকল জাতের ধান পরিপুষ্ট হবার অপেক্ষায় রয়েছে। এই অবস্থায় পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এসব ধান নষ্ট হয়ে গেছে।

এ সময়ে যারা ধান কেটেছে তাদের মাড়াই করা বা শুকানোর মতো কোন জায়গা নেই। বিভিন্ন কৃষকের সাথে কথা বলে শুধু হাহাকার আর আক্ষেপ শোনা যায়। নিকলী নতুন বাজার বণিক সমিতির সভাপতি করম আলী জানান- কিছু জমির ধান কেটেছেন। কিন্তু শুকানোর জায়গা নেই কিংবা বাড়িতে আনার মতো সুযোগ নেই।

নাগারছিহাটি গ্রামের মৃত আঃ রহমান-এর দুই ছেলে মোঃ জাফরান (৪৮) এবং মোঃ শহীদ (৫০) প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। তারা প্রায় ২০-২২ একর জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন। অদ্যাবধি কোন ধান কাটতে পারেননি। একই অবস্থা নিকলী জিসি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারি রবিনের। জাফরান বলেন, সরকার সহযোগিতা করলে এই এলাকার মানুষের দুঃখ অনেকটা দূর হতো।

দুর্গতির এ সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা মারফত জানা গেছে, আগাম বন্যা বা অসময়ে ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢল মোকাবিলায় সরকারের বাঁধ নির্মাণের বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছিলো; যেগুলো ২০১৬ সালের মধ্যে প্রকল্প কাজ শেষ করার কথা। অথচ বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ করার জন্যে আরো অতিরিক্ত দুই বছর সময় চাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে হাওরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। চোখে-মুখে একই জিজ্ঞাসা, কৃষকদের রক্ষা বাঁধ কার বা কাদের কল্যাণে বন্ধ করা হলো! তদন্তসাপেক্ষে এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন নিঃস্ব হয়ে পড়া মানুষগুলো।

যদি খুব দ্রুত পানি না কমে তাহলে যৎসামান্য যেটুকু ফসল অবশিষ্ট আছে তাও নষ্ট হয়ে যাবে। এই অবস্থায় হাওরের কৃষকের ঘরে নববর্ষের আনন্দ নেই, রয়েছে কেবল সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুল প্রার্থনা। আমাদের রক্ষা করো প্রভু।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্ট

ছবি ও ভিডিও : লেখক

Similar Posts

error: Content is protected !!