বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল শুধু নদী ও বন্যার গল্পে সীমাবদ্ধ নয়; এখানে লুকিয়ে আছে শত বছরের জীবিকা ও সংগ্রামের অনন্য ইতিহাস। একসময় গোবরের লাকড়ি, খরস্রোতা নদীতে জেলেপেশা, কিংবা মৌসুমি কৃষিকাজ—এসবের ভেতরেই গড়ে উঠেছিল হাজারো মানুষের জীবনযাত্রা। আধুনিকতার ঢেউয়ে অনেক পেশাই আজ বিলুপ্তপ্রায়। সেই হারানো ঐতিহ্য ও টিকে থাকা সংগ্রামের গল্প নিয়ে শুরু হয়েছে নিকলীকেন্দ্রিক প্রথম অনলাইন সংবাদমাধ্যম “আমাদের নিকলী ডটকম”-এর ধারাবাহিক ফিচার প্রতিবেদন—“হাওরাঞ্চলের ব্যতিক্রমী জীবিকা”। আজ থাকছে “বাদাম বাছা”
মোহাম্মদ তোফায়েল আহছান ।।
কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল বাংলাদেশের এক অনন্য কৃষিপ্রধান অঞ্চল। এখানে চরাঞ্চলের বেলে ও বেলে-দোআঁশ মাটি ধান, ভুট্টা, সবজি সহ নানা ফসলের জন্য বেশ উপযোগী। এর পাশাপাশি এই অঞ্চলে ব্যাপক হারে উৎপাদিত হয় চিনাবাদাম। মাটির গঠন, জলবায়ুর উপযোগিতা এবং সঠিক চাষপদ্ধতির কারণে চরাঞ্চলের কৃষকরা বাদামকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমি ফসল হিসেবে চাষ করেন।
হাওরাঞ্চলে সাধারণত বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর নদীর চরে বাদাম চাষ করা হয়। এই সময়টি হলো অগ্রহায়ণ মাস থেকে মধ্য-পৌষ মাস (নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর)। বাদাম গাছ পুষ্ট হতে ১২০ থেকে ১৫০ দিন (৪ থেকে ৫ মাস) সময় লাগে। বীজ বপনের ৪ থেকে ৫ মাস পর, অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাসের দিকে বাদাম পুষ্ট হলে গাছ উত্তোলন করা হয়। এই সময়টি হাওরে ধান কাটার সময়ের সঙ্গে মিলে যায়।
চিনাবাদাম কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকেই মূল্যবান নয়, বরং পুষ্টিগুণে ভরপুর হওয়ায় এটি স্থানীয় মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। বাদামের উৎপাদন প্রক্রিয়া কৃষকের ধারাবাহিক শ্রম ও যত্নের ফল। ধান বা অন্যান্য ফসলের মতো বাদামও বিভিন্ন ধাপে চাষ করা হয়—বীজ বপন, মাটির যত্ন এবং পরে গাছ থেকে বাদাম ছাড়ানো বা গাছ থেকে বাদাম বাছা পর্যন্ত।
গাছ থেকে বাদাম ছাড়ানো বা বাছার কাজটি কোনো সাধারণ কাজ নয়। এটি সময়সাপেক্ষ, শ্রমসাধ্য এবং পরিবারের বহু সদস্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণের প্রয়োজন হয়। শারীরিক পরিশ্রম, ধৈর্য ও সতর্কতা ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন করা কঠিন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বাদাম আলাদা করতে গিয়ে হাত ও আঙুলে ক্ষত, ফোসকা বা জ্বালা সহ্য করতে হয়। শিশু-কিশোররাও পারিবারিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে এ কাজে যুক্ত থাকে, ফলে এটি কেবল একটি কৃষি প্রক্রিয়া নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের অদৃশ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত।
ক্ষেতজুড়ে ছড়িয়ে বসে আছেন গ্রামের নারী আর শিশু-কিশোরেরা। কারও হাতে বাদামের গাছ, কেউ বা মাটিতে বসে একমনে বাদাম ছাড়াচ্ছেন। পরিশ্রমে ভেজা মুখে আছে তৃপ্তির হাসি—এই শ্রমই তো তাদের জীবিকার মূল ভরসা। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে নারীরা মাঠে নেমেছেন, শিশুরা শিখছে কাজের মধ্য দিয়ে জীবন বোঝার পাঠ। বাদাম বাছা তাদের কাছে শুধু কৃষিকাজ নয়, টিকে থাকার এক অনড় সংগ্রাম, এক অজানা জীবনের গল্প।
এই প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অর্থনীতি, পরিবারিক জীবনযাত্রা এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোও তৈরি হয়। বাদাম ছাড়ানো ও উৎপাদন শুধুমাত্র খাদ্য ও অর্থনৈতিক উৎস নয়, এটি চরাঞ্চলের কৃষিজীবী পরিবারের শ্রম ও সহায়তার এক স্বতন্ত্র পরিচায়ক।

ফসল ঘরে তোলার উৎসব
ধান কাটার মতো বাদাম তোলাও কৃষকদের কাছে এক ধরনের উৎসব। প্রতিকূলতা পেরিয়ে যখন বাদাম পরিপুষ্ট হয়, কৃষকের মুখে ফুটে ওঠে হাসি। শুরু হয় জমি থেকে বাদাম গাছ তোলার কাজ। ক্ষেতজুড়ে তখন ছড়িয়ে পড়ে শুকনো মাটি, কচি পাতা আর সদ্য তোলা বাদামের গন্ধ। মৌসুমি শ্রমিকদের সঙ্গে কৃষক নিজেও এই কাজে অংশ নেন।
চরে সরাসরি সড়কপথ না থাকায় গাছগুলো আঁটি বেঁধে বোঝা বানানো হয়। এরপর নদীপথে নৌকা বা ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে বহন করে লোকালয়ে আনা হয়। নদীর ঘাটে পৌঁছানোর পর ফুটে ওঠে এক ভিন্ন দৃশ্য—সেখানে আগে থেকেই ভিড় করে থাকেন বহু মানুষ। গাছগুলো ভাগাভাগি করে নেয়ার প্রতিযোগিতা চলে, কারণ বাদাম ছাড়ানোর পর শুকনো গাছগুলো জ্বালানি লাকড়ি হিসেবে ব্যবহারের জন্য তারা সংগ্রহ করেন। এ নিয়েও কখনো কখনো ছোটখাট বাদানুবাদের ঘটনা ঘটে।
লোকালয়ের কাছাকাছি থাকা ক্ষেতগুলোতে বাদাম তোলার দৃশ্য যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে। সাধারণত বাদাম গাছ তোলার মৌসুমে ভোর থেকেই কৃষক-শ্রমিকেরা জমিতে নেমে পড়েন। জমির এক প্রান্তে কয়েকজন শ্রমিক লতাপাতা-ভরা বাদামগাছ মাটি থেকে উপড়ে নিচ্ছেন, অন্য প্রান্তে আবার বসে বসে নারীরা, বয়স্করা কিংবা শিশু-কিশোরেরা সেই তোলা গাছ থেকে বাদাম ছাড়ানোর কাজে ব্যস্ত।
গাছের শিকড়ে-মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা বাদাম ধীরে ধীরে আলাদা করা হয়। এক একজন হাত দিয়ে মুঠো মুঠো করে ঝাড়ছেন, আবার কেউ কেউ গাছে জড়ানো বাদাম ধরে মোচড়ে মোচড়ে তা ছাড়াচ্ছেন। চারপাশে ছড়িয়ে থাকে সবুজ ও শুকনো পাতার গন্ধে মাখা বাদামের খোসা। অনেক সময় শিশুরাও আনন্দ করে এই কাজে যোগ দেয়—কেউ ঝুড়িতে বাদাম ভরে রাখে, কেউবা খেলার ছলে গাছের গোড়া থেকে কাঁচা বাদাম কুড়িয়ে নেয়।
এভাবে একসঙ্গে গাছ তোলা আর বাদাম ছাড়ানোর ফলে কাজ এগোয় দ্রুত। ক্ষেতের ধারে ধারে সাজানো থাকে বাঁশের তৈরি বড় বড় ঝাঁকা, টুকরি, ওড়া ও বস্তা যেখানে ফসল তোলা বাদাম জমা করা হয়। তারপর এগুলো রোদে শুকানোর জন্য বাড়ির উঠোনে বা খোলা মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। বাদাম তোলার মৌসুমে গ্রামীণ জনপদের সেই ক্ষেতজীবন হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত, কর্মব্যস্ত এবং সামাজিক মিলনমেলার মতো।

গাছ থেকে বাদাম ছাড়ানোর বিনিময় প্রথা
বাদাম ক্ষেতের সবগুলোই লোকালয়ের কাছাকাছি থাকে না। যেসব ক্ষেত লোকালয় ছাড়িয়ে, নদী পেরিয়ে দূর চরাঞ্চলে রয়েছে সেসব ক্ষেত থেকে বাদাম গাছ তোলা শেষে নদীপথে ট্রলারে করে লোকালয়ে আনা হয়। ট্রলারের বোঝা ভর্তি তোলা গাছ ধীরে ধীরে হাওরের নৌপথ ধরে ভেসে আসে, পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষ, হাঁটু জল ও নাব্য নদীর দৃশ্যের সঙ্গে একধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। ট্রলার থেকে গাছ নামানো হয় সবাই মিলে, আর শিশু-কিশোরদের ছোট ছোট দৌড়ঝাঁপ, নারীদের হাসি-মজার আলাপ ও পুরুষদের পরিশ্রম—সব মিলিয়ে কাজটি হয়ে ওঠে সামাজিক মিলনের এক অঙ্গ।
এরপর শুরু হয় বাদাম ছাড়ানোর কাজ। এটি শুধু শ্রমের কাজ নয়, বরং এক ধরনের বিনিময় ও সহযোগিতার প্রথাও তৈরি করেছে। প্রথাটি এইভাবে কাজ করে—
যারা শ্রম দিয়ে বাদাম ছাড়ান, তারা তোলা বাদাম কৃষকের কাছে ফিরিয়ে দেন এবং গাছের অবশিষ্ট অংশ নিজেরা নিয়ে যান।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রমের বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ বাদাম দেওয়ার ব্যবস্থাও থাকে।
গাছগুলো আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হলে, গাছের অংশ ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়, যাতে শ্রমিক ও কৃষক উভয়ের সুবিধা হয়।
শ্রমিক সংকট দেখা দিলে কৃষকরা পুরো গাছের সঙ্গে বাদামের কিছু অংশও অফার করেন, যাতে কাজ দ্রুত সম্পন্ন হয়।
প্রাকৃতিক অবস্থা ও আবহাওয়ার গুরুত্বও এ প্রথায় প্রতিফলিত হয়। যদি খারাপ আবহাওয়ার কারণে দ্রুত বাদাম সংগ্রহের প্রয়োজন হয়, তাহলে শ্রমিকদের কাজের গুরুত্ব বাড়ানো হয়। আর কোনো কারণে পর্যাপ্ত লোক না পাওয়া গেলে কৃষকরা নিজেই আগ্রহী পরিবারের আঙিনায় গাছ পৌঁছে দিয়ে আসেন।
গাছ থেকে বাদাম ছাড়ানো হয়ে গেলে তা বস্তায় ভরে কৃষক ঘরে ফেরত আনেন। পুরো প্রক্রিয়া চলাকালে দেখা যায়—হাতের ক্ষত, ফোসকা, ঘামের জলে ভিজা পোশাক, শিশুদের কৌতূহলপূর্ণ দৌড়ঝাঁপ, নারীদের হাসি-মজার আলাপ এবং পুরুষদের পেশীবহুল পরিশ্রম। এসব দৃশ্য একত্রে গ্রামীণ জীবনের শ্রম, সহানুভূতি ও সামাজিক বন্ধনের এক প্রাণবন্ত চিত্র গড়ে তোলে।
ফলে, বাদাম ছাড়ানো কেবল অর্থনৈতিক লেনদেন নয়, এটি স্থানীয় গ্রামীণ সমাজে সহযোগিতা, বিশ্বাস এবং পারস্পরিক সমঝোতার এক অদৃশ্য জালও তৈরি করে। এটি পরিবার ও সমাজের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয়কে দৃঢ় করে, একই সঙ্গে শ্রমের মূল্য এবং সামাজিক সম্পর্কের গুরুত্বও স্পষ্ট করে।

গাছ থেকে বাদাম ছাড়ানোর স্মৃতিকথা
আব্দুল গফুর মিয়া (৭২), প্রবীণ কৃষক : “আমরার ছুডোবেলায় বাদাম তোলা মানে আছিলো পুরাই হল্লাহল্লি। হাত দিয়া গাছ তুলতাম, পরে উঠানে বইসা গাছ থেইকা বাদাম ছিড়া আলগা করতাম। সারা দিনমান কাম কইরাও সারাইতে ফারতাম না। রাইতেও কাম করন লাগত। পূর্ণিমার রাইত অইলে ফারার অনেক ফোলাফান মিইলা গাছ থেইকা বাদাম ছিড়ত। রাইতের বাদাম গাছ বাছায় আনন্দ বেশি অইতো। কষ্ট আছিলো; কিন্তু সবাই মিইলা করনে মজা অইতো বেশি।”
হাজেরা খাতুন (৬৫), গৃহিণী : “আমার বিয়া হইছিলো বন্যার বছরে। ওইবার বন্যা শেষে হগলের খেতেই গাছে বাদাম ভইরা অইছিলো। আমি নতুন বউ, শরমে বেশি সামনে যাইতাম না; কিন্তু সন্ধ্যার ফরে দরে বইয়া হগলের লগে বাদাম ছিড়তাম। মাঝে মইদ্যে কাচা বাদাম লবণ দিয়া হিজায়া যারা বাদাম ছিড়তে আইতো সবাইরে লয়া খাইতাম। তহন ভাজা বাদামের থেইকা সিদ্ধ বাদাম বেশি মজা লাগত। আমি চুপচাপ দেকতাম আর ফোলাফাইন, বেইট্টাইনতের আলাফ হুনতাম। হাসি-তামশা—মনে অইতো বাদাম ছিড়া না, যেন গেরামের মেমানদারির আয়োজন।”
রওশন আরা (৬৮), প্রবীণ নারী : “আগে তো মোবাইল-টিভি কিছুই আছিলো না। গিরস্তি শুরু অইলেই সবাই কামে লাইগ্গা যাইতো। ধান তোলায় যেমুন, বাদাম তোলারও কী ধুম আছিন। তবে গাছ থেইকা বাদাম ছিড়ার সময় আমরার আড্ডা, সুখ-দুককের আলাফ করতাম। খালি কাম না, এইডাই আছিলো আমরার বিনোদন। ফোলাফানে বাদাম উরাত ভরতে ভরতে গুনগুন কইরা ছন্দে ছন্দে কতা কইত—‘বাদাম তুলবি বাদাম?’ হে হে হে হে। এখন এইসব নাই, সবই যনতের মতন অয়া গেছে।”
শেফালী বেগম (৩৫), কৃষাণী : “ভোরে ঘুম থেইকা উডি। আগে ঘর-দুয়ার গুছাই, তার ফরে উডানে বইয়া সবার লগে বাদাম ছিড়ি। একবারে সোজা কাম না, হাত ফাইটা যাগা, ফোসকা ফরে। না করলে তো আর ছলতো না। একটু কষ্ট করলে খড়ির খরচ কিছুডা কমান যায়। আগে নাহি আরো কত কী অইতো বাদাম ছিড়ার সময়। এহন অতকিছু আর দেহি না। খালি বড়রার থেইকা কিচ্চা হুনি। হুনতে আমার ভালই লাগে।”
রিনা আক্তার, স্কুলপড়ুয়া : “পড়াশুনার ফাহে মায়ার লগে বাদামগাছ বাছি। খেলতে খেলতেই করি। আগে থেইকা এহন হাত ফাইক্কা গেছে। তবু বাদাম বাছতে আঙুল বেদনা করে। কিন্তু করি। মায়া কইছে—যা ফারছ কর। এইডাই আমরার কামে আইবো।”
আব্দুল খালেক (৭৫), অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক : “আমার ছাত্রজীবনেও বাদাম তোলার মৌসুম ছিলো আলাদা আনন্দের। স্কুলের ছুটির পর আমরা বন্ধুরা মিলে গ্রামের জমিতে যেতাম। গাছ থেকে বাদাম ছাড়াতে সাহায্য করতাম। তখন ভাবতাম, এতো কষ্টের কাজ কেন মানুষ করে? বয়স বাড়ার পর বুঝলাম, এই বাদাম গাছই গ্রামের অনেক পরিবারের জ্বালানির বড় ভরসা। আমার মতে, এই শ্রমকে ‘গৃহস্থালি কাজ’ না বলে প্রকৃত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।”
জাহাঙ্গীর আলম (৫০), সমাজসেবক : “চরাঞ্চলের কৃষি ও অর্থনীতিতে বাদাম একটা বড় অবদান রাখে। কিন্তু গাছ থেকে বাদাম ছাড়ানোর মতো শ্রমসাধ্য কাজ এখনো অদেখা বা অবহেলিত থেকে গেছে। নারী, শিশু-কিশোরদের এই অবদান আমরা হিসাব করি না। অথচ এই বাদাম বাজারে উঠতে এবং নিজেদের পরিবারের রান্নার জ্বালানির যোগান দিতে তাদের শ্রম রয়েছে। আমি চাই, সরকার ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা একসাথে কাজ করে বাদাম ছাড়ানোর প্রক্রিয়ায় কিছু প্রযুক্তিগত সহায়তা দিক। আর নারী, শিশু-কিশোরদের শ্রমের স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা হোক। তাহলেই বাদাম চাষ আরও লাভজনক আর মানবিক হবে।”

জ্বালানি হিসেবে বাদামগাছ
হাওরাঞ্চলে বহুদিন ধরেই জ্বালানির লাকড়ির সংকট বিরাজমান। জলবেষ্টিত এ অঞ্চলে বড় গাছপালা তুলনামূলক কম জন্মায়, আর যেসব সামান্য ঝোপঝাড় বা বৃক্ষ থাকে সেগুলোও বন্যার পানিতে প্রায়ই ভেসে যায়। ফলে রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় লাকড়ি সংগ্রহ করা এখানকার সাধারণ মানুষের জন্য দীর্ঘদিনের এক বড় চ্যালেঞ্জ।
এমন বাস্তবতায় বাদাম ফসল যেন আশীর্বাদ হয়ে আসে। বাদাম তোলার মৌসুম শেষে জমিতে বিপুল পরিমাণ গাছ পড়ে থাকে। এই গাছগুলো খুব সহজে শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বাদামগাছ দ্রুত শুকিয়ে শক্ত হয় এবং আগুন ধরলে ভালোভাবে জ্বলে—যা রান্নার কাজে অত্যন্ত কার্যকর। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, বাদামগাছ জ্বালানোর সময় তুলনামূলকভাবে কম ধোঁয়া হয়। ফলে চোখ ও শ্বাসযন্ত্রের জন্যও কম ক্ষতিকর।
স্থানীয় কৃষকদের মতে, এক মৌসুমে যে পরিমাণ বাদামগাছ সংগ্রহ করা যায়, তা দিয়ে গড়ে তিন থেকে চার মাসের জ্বালানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। কোনো কোনো পরিবার আবার অতিরিক্ত গাছ মজুত করে রাখে বা বিক্রি করে নগদ অর্থ উপার্জন করে। অর্থাৎ বাদাম শুধু খাদ্যশস্য বা বাজারজাত ফসল নয়, বরং হাওরাঞ্চলের অসচ্ছল পরিবারের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তারও অন্যতম উৎস।
অন্যদিকে, হাওরের পরিবারগুলোর বিকল্প জ্বালানি উৎস যেমন—ধানের খড়, তুষ, কুড়া বা ছোহল—এসব জ্বালানি অস্থায়ী এবং অপ্রতুল। ধানের খড় দ্রুত শেষ হয়ে যায়, অন্য বিকল্প জ্বালানিগুলোও প্রস্তুত করতে সময় লাগে। এই প্রেক্ষাপটে বাদামগাছ তুলনামূলকভাবে বেশি নির্ভরযোগ্য ও সহজলভ্য।
গৃহিণী শাহিদা আক্তার বলেন, “ হুলা (পাটকাঠি) বা খের (খড়) জ্বালাইলে অনেক ধোঁয়া হয়, চোখ জ্বলে। কিন্তু বাদামের গাছ ভালোই জ্বলে, ধোঁয়াও কম হয়। এতে রান্না সহজ হয়।”
তাই স্থানীয়দের কাছে বাদামগাছ কেবল কৃষিপণ্যের উপজাত নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি অসচ্ছল পরিবারকে একদিকে রান্নার জ্বালানির নিশ্চয়তা দেয়, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে খানিকটা স্বস্তিও এনে দেয়।
টেকসই দিক ও পরিবেশগত প্রভাব
বাদামগাছকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা এক ধরনের পরিবেশবান্ধব পুনঃব্যবহার (reuse)। কারণ, বাদাম তোলার পর জমিতে গাছ ফেলে রাখলে তা নষ্ট হয়ে যেত বা পচে মাটিতে মিশে যেত। এর পরিবর্তে এগুলো জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগানো মানে হচ্ছে কৃষি-উপজাতকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা।
তবে এর একটি সীমাবদ্ধ দিকও আছে। যদি পুরো বাদামগাছ রান্নার কাজে জ্বালিয়ে ফেলা হয়, তাহলে মাটিতে জৈব সার হিসেবে গাছের অবশিষ্টাংশ ফেরত যায় না, যা দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা কিছুটা কমাতে পারে। এজন্য অনেক বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেন—বাদামগাছের একটি অংশ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হোক, আরেকটি অংশ জৈব সার বানাতে মাটিতে ফেরত দেওয়া হোক।
সব মিলিয়ে, বাদামগাছকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা একদিকে অসচ্ছল পরিবারের জন্য টেকসই সমাধান, অন্যদিকে পরিবেশের প্রতি যত্নশীল ব্যবহারের মাধ্যমে এটি হতে পারে দ্বিমুখী লাভজনক ব্যবস্থা।
শ্রমসাধ্য হলেও মূল্যায়ন নেই
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনজীবনে বাদাম ছাড়ানোর কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে হাজারো পরিবার। বাদাম চাষ ও ফসল তোলার পর এই ধাপটিই সবচেয়ে শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। সাধারণ ধারণায় কাজটি সহজ মনে হলেও বাস্তবে বাদাম ছাড়ানো অত্যন্ত কষ্টকর ও ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়া একটি প্রক্রিয়া।
বাদামগাছ মাটি থেকে তোলার পর শেকড়ে আটকে থাকা বাদামগুলো একে একে আলাদা করতে হয়। এ কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিচু হয়ে বসে থাকতে হয়। দীর্ঘসময় এভাবে কাজ করলে হাত ও আঙুলে ঘষা লেগে ক্ষত, ফোসকা কিংবা কেটে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। গরমের দিনে ঘামে ভিজে গেলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে ওঠে।
শুধু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা নারীই নয়, শিশু-কিশোররাও বাদাম ছাড়ানোর কাজে অংশ নেয়। স্কুল বন্ধের সময়ে কিংবা ছুটির দিনে তারা পরিবারকে সাহায্য করে। অনেক সময় ছোট ছোট শিশুরা খেলার ছলে বাদাম ঝুড়িতে ভরতে কিংবা গাছ ঝাড়তে যুক্ত হয়। যদিও এ কাজ তাদের কাছে আনন্দের মতো মনে হয়, কিন্তু শ্রমের তীব্রতায় শারীরিকভাবে তারাও ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
বহু বছর ধরেই বাদাম ছাড়ানোর এই প্রথা চলে আসছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো—কৃষিজীবী মানুষ এই কাজকে কোনো স্বতন্ত্র পেশা বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। অধিকাংশের কাছে এটি এখনও “গৃহস্থালি কাজ” বা পারিবারিক সহযোগিতার অংশ হিসেবেই সীমাবদ্ধ। ফলে যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাদাম ছাড়ানোর কাজে যুক্ত থাকেন, তারা আলাদা কোনো মজুরি বা শ্রমের মূল্য পান না। বরং একে পারিবারিক দায়িত্ব বা মৌসুমি কাজ হিসেবেই ধরা হয়।
নারী ও শিশু শ্রমের সামাজিক দিক
এই কাজে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। অনেক নারী ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বাদাম ছাড়ানোর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাদের এই শ্রম আলাদা করে দৃশ্যমান হয় না। বাজারে বিক্রিত বাদাম গাছের লাভ পরিবারের পুরুষ সদস্যদের হাতে গেলেও নারী শ্রমের মূল্যায়ন প্রায় অনুপস্থিত। শিশুরাও পারিবারিক সহায়তা হিসেবে যুক্ত হয়; কিন্তু এটিও শিশু শ্রমের একটি রূপ—যা সমাজে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
ফলে নারী ও শিশুর শ্রম এখানে “অদৃশ্য শ্রম” হিসেবে থেকে যায়। পরিবারে বাদাম ফসল থেকে যে আয় হয়, তার পেছনে নারী ও শিশুর শ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও সেটি কোনো আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না।

অদৃশ্য শ্রমের স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা
বাদাম ছাড়ানোর কাজকে যদি “গৃহস্থালি কাজ” নয় বরং একটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তবে—নারীর শ্রমের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে, শিশুদের ওপর চাপ কমবে, আর্থিকভাবে এই শ্রমের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব হবে।
সব মিলিয়ে, গাছ থেকে বাদাম ছাড়ানো শুধু একটি মৌসুমি কাজ নয়, বরং হাজারো পরিবারের বেঁচে থাকার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অদৃশ্য অর্থনীতি। এর সঠিক মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি দিলে কৃষিজীবী সমাজে নারীর ভূমিকা ও শিশুদের অধিকার আরও সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হবে।
উৎসবমুখর পরিবেশ
পরিশ্রমের কাজ হলেও গাছ থেকে বাদাম ছাড়ানো গ্রামে গ্রামে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করে। দিনে যেমন, রাতের বেলাতেও উঠোনে বসে দল বেঁধে বাদাম ছাড়াতে দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশু-কিশোররাও বাদাম ছাড়ানোর কাজে অংশ নেয়। চাঁদনি রাত বা পূর্ণিমার রাতে উঠোনে বসে দল বেঁধে বাদাম ছাড়ানোর কাজ খুবই উপভোগ্য হয়। তখন গল্প, আড্ডা, হাসি-তামাশায় চারপাশ উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।
কেউ এক ফাঁকে মজার গল্প বলতে শুরু করলে অন্যরা হেসে গড়াগড়ি খায়। গ্রামের বয়স্করা অতীতের গল্প টেনে আনেন—“কোন সালে বন্যা বেশি হয়েছিল, কোন মৌসুমে বাদাম ভালো হয়েছিল”—এসব স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে হয়ে ওঠে শিক্ষার মতো। পারিবারিক ও সামাজিক নানা তথ্যও এ সময় একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। ফলে শ্রমসাধ্য এই কাজ গ্রামীণ সমাজে পরিণত হয় সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উল্লাসে ভরা এক মিলনমেলায়।
আরো যেসব অঞ্চলে বাদাম চাষ হয়
রংপুর ও উত্তরাঞ্চল: রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী—এই পাঁচটি জেলায় বাদাম চাষ ব্যাপক হারে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ও বরিশাল অঞ্চল: চট্টগ্রাম ও বরিশাল অঞ্চলেও বাদাম চাষের পরিসর বাড়ছে। বিশেষ করে চরাঞ্চল ও বালিযুক্ত জমিতে বাদাম চাষ লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা আগ্রহী হচ্ছেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে চিনাবাদাম চাষ ও ছাড়ানো পদ্ধতি
চিনাবাদামের আদি উৎস দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকা হলেও বর্তমানে চীন, ভারত, নাইজেরিয়া, সুদান, সেনেগাল, বার্মা, গিনি, আর্জেন্টিনা, তানজানিয়া, মধ্য আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উষ্ণমন্ডলীয় ও ক্রান্তীয় দেশে এর ব্যাপক চাষাবাদ হয়। বিশ্বের বৃহত্তম চিনাবাদাম উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে চীন। এর পরেই রয়েছে ভারতের অবস্থান।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে বড় আকারের খামারে, চিনাবাদাম গাছ টেনে মাটি থেকে তুলে নেওয়া হয় এবং রোদে শুকানোর পর কম্বাইন মেশিনের মাধ্যমে বাদামগুলো গাছ থেকে ছাড়ানো হয়। প্রথমে চিনাবাদাম ফসল তোলার সময় মাটি থেকে তুলে, ঝেড়ে পরিষ্কার করা হয় এবং রোদে শুকানো হয়। এরপর, একটি কম্বাইন হার্ভেস্টার ব্যবহার করে বাদামগুলো গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। গাছের লতাগুলো মাটির উর্বরতা বাড়াতে কম্পোস্ট সার বানাতে ব্যবহার করা হয়। অথবা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার জন্যও সংগ্রহ করা হয়।
হাওরাঞ্চলে বাদাম ছাড়ানো কেবল একটি মৌসুমী কৃষিকর্ম নয়; এটি এই অঞ্চলের গ্রামীণ জীবনের এক অদৃশ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদান। শ্রমিক ও কৃষক, নারী ও শিশু—অবধি পরিবারিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই কাজ সম্পন্ন হয়, যেখানে শ্রম, ধৈর্য এবং পারস্পরিক সহযোগিতা একত্রিত হয়। যদিও অধিকাংশের কাছে এটি “গৃহস্থালি কাজ” হিসেবে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর অর্থনৈতিক মূল্য ও সামাজিক গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাদাম ছাড়ানোর প্রক্রিয়া স্থানীয় অর্থনীতি, পরিবারিক জীবন এবং সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে, একই সঙ্গে শ্রমের অদৃশ্য অবদানকে প্রতিফলিত করে। টেকসই ব্যবস্থাপনা, যথাযথ স্বীকৃতি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করলে এই প্রথা আরও কার্যকর, মানবিক এবং উৎপাদনশীল হতে পারে। সুতরাং, বাদাম ছাড়ানো শুধু ফসলের শেষ ধাপ নয়, এটি হাওরাঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সংস্কৃতি এবং সামাজিক পরিকাঠামোর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
হাওরের এই বাদামক্ষেতগুলো শুধু ফসলের মাঠ নয়—এগুলো একেকটি পরিবারের টিকে থাকার ইতিহাস। নারীরা প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মাটিতে বসে বাদাম ছাড়ান, হাতে ফেটে যায়, তবুও হাসিমুখে ফেরেন ঘরে। শিশু-কিশোররাও মায়ের পাশে থেকে শেখে শ্রমের মানে, দায়িত্বের পাঠ। তবু এই অগণিত পরিশ্রমের কোনও সঠিক মূল্য নেই—না অর্থনৈতিক হিসাবপত্রে, না সমাজের স্বীকৃতিতে। বাদাম বাছা যেন তাদের জীবনের এক নিঃশব্দ অধ্যায়, যেখানে ঘাম আর মমতার মিশ্রণে লেখা থাকে জীবিকার গল্প। হাওরের বাতাসে সেই গল্প আজও ভেসে বেড়ায়—অদেখা, অথচ গভীরভাবে মানবিক।
লেখক: সংবাদমাধ্যম কর্মী


