স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ফল ও সবজির বীচি

খাইরুম মুনিরা তিথী ।।

সবজি রান্না করার আগে কিংবা ফল খাবার সময় আমরা স্বাভাবিকভাবেই এর বীচিগুলো ফেলে দিই। কিন্তু এমন অনেক ফল ও সবজি রয়েছে যেগুলোর বীচি বহু পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চলুন তবে জেনে নিই এমন কিছু ফল ও সবজির কথা…

পেঁপে
সুস্বাস্থ্যের জন্য পেঁপে বীজ অত্যন্ত উপকারী। এতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রোটিন, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম। পেঁপে বীজ যেমন এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ তেমনি এটা প্রদাহনাশক, কৃমিনাশক ও ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর। এতে বিদ্যমান পেপেইন ও কাইমোপেপেইন এনজাইম প্রদাহ দূর করে আর্থ্রাইটিসের ব্যথা দূর করতে সাহায্য করে। এই বীজের কারপেইন নামক এলকোলোয়েড কৃমি ও এমিবা ধ্বংস করে। এছাড়াও এর প্রোলাইটিক এনজাইম অন্ত্রকে পরজীবীমুক্ত রাখে। পেঁপের বীচিতে উপকারি গ্লুকোট্রোপিওলিন থাকে যা শরীরে বিপাকের মাধ্যমে শক্তিশালী ক্যান্সারবিরোধী উপাদান আইসোথায়োসায়ানেট উৎপন্ন করে। পেঁপের সেবন মাত্রা হলো ৫–৭ গ্রাম। খেতে পারেন স্যুপ বা সালাদের সাথে অথবা রান্নাতেও ব্যবহার করতে পারেন। তবে এটা যেহেতু প্রাকৃতিক গর্ভনিরোধক তাই গর্ভবতী মহিলা বা যারা সন্তান গ্রহণে ইচ্ছুক তারা অবশ্যই এড়িয়ে চলবেন।

বাঙ্গী
World Applied Science জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস হলো বাঙ্গী বীচি। প্রতি বীজে রয়েছে ৩.৫% প্রোটিন, ৪% ফ্যাট, ২.৫% কার্বোহাইড্রেট। সেই সাথে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন এ, বি১, বি২, সি, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড। এই বীজ উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। মাইগ্রেন, অনিদ্রা, ডিপ্রেশন দূর করতে সাহায্য করে। মূত্রসংবহনতন্ত্রের ইনফেকশন প্রতিকার ও অন্ত্রের কৃমি নাশেও কার্যকর। গ্রহণ মাত্রা ৩–৬ গ্রাম।

কালোজাম
টাইপ–২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য জাম বীজ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এতে বিদ্যমান গ্লুকোসাইড জ্যাম্বুলিন প্যানক্রিয়াসের বিটাকোষ থেকে ইনসুলিন উৎপাদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক চা চামচ জাম বীজ পাউডার প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে। কালো জামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, প্রোটিন, ফ্ল্যাভোনয়েডস, ওমেগা৩ ও ওমেগা৬, ফ্যাটি এসিড, ক্যারোটিনয়েড, আয়রন, ফলিক এসিড, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কালোজামের বীচিতে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

সাইট্রাস জাতীয় ফল
বিভিন্ন সাইট্রাস জাতীয় ফল যেমন– লেবু, আঙ্গুর, কমলা কিন্তু নিরাপদ। লেবুর বীচিতে স্যালিসাইলিক এসিড থাকে। লেবুর বীচিতে স্যালিসাইলিক এসিড থাকে যা অ্যাসপিরিনের প্রধান উপাদান। অতএব এই বীজ খেলে তা ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করবে।

অ্যাভোকাডো
অ্যাভোকাডোর বীচি শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট। এই ফলের সত্তর ভাগ এন্টিঅক্সিডেন্ট এর বীচিতেই থাকে। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ দ্রবণীয় ফাইবার ও পটাশিয়াম বিদ্যমান। অ্যাভোকাডো বীজ হাই ব্লাড প্রেশার, হাই কোলেস্টেরল কমায়, স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে, পরিপাকনালীর প্রদাহ প্রতিরোধ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

কাঁঠাল
প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালের বীচিতে এনার্জি পাওয়া যায় প্রায় ৯৮ ক্যালোরি। এতে চর্বি আছে ০.৪ গ্রাম, প্রোটিন আছে ৬.৬ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট আছে ৩৮.৪ গ্রাম এবং ফাইবার আছে ১.৫ গ্রাম। এছাড়াও কাঁঠালের বীচিতে আছে নানা ধরনের ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট। এতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফাইবার, ক্যালসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ১, ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন সি। কাঁঠাল বীজ শক্তিশালী এন্টি অক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং বার্ধক্যের দ্রুত আনয়ন রোধ করে। এতে বিদ্যমান লিগন্যান, আইসোফ্ল্যাভোন, স্যাপোনিন যা নানা রোগ হতে দেহকে সুরক্ষা করে। উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার হওয়ায় এটা গরীবের আমিষের বিকল্প। ফাইবার ও কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট এর কারণে এর গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স কম। ফলে উচ্চ শক্তিদায়ক খাবার হলেও এতে ওজন বৃদ্ধি হবে কম। পশ্চিমা বিশ্বের ফুড সায়েন্টিস্টরা তাই কাঁঠালের বীচির পাউডারকে ময়দা হিসেবে ব্যবহার করে কেক, বিস্কুট, বানানোর লক্ষ্যে গবেষণা করে যাচ্ছে।

তরমুজ
তরমুজ বীজ ফাইবার, ভিটামিন বি, নায়াসিন, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন ও জিঙ্কের একটি চমৎকার উৎস। জিংক বিভিন্ন ধরণের এনজাইম পরিচালনার জন্য এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয়। যেহেতু এই পুষ্টি উপাদানটি দীর্ঘদিন শরীরে জমা থাকেনা তাই আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় জিংক সমৃদ্ধ খাবার থাকা জরুরি। তরমুজের বীচিতে উচ্চমাত্রার অ্যামাইনো এসিড আরজিনিন থাকে। যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং করোনারি হার্ট ডিজিজ নিরাময়ে সাহায্য করে। নিয়মিত এই বীচি খেলে চুল নখ ত্বক সুন্দর থাকে। মূত্র সংবহনতন্ত্রের ইনফেকশন দূর করতেও কার্যকর তরমুজ বীজ। সেবন মাত্রা ২ থেকে ৬ গ্রাম।

অবশ্য আপেল, নাশপাতিতে রয়েছে যৎসামান্য প্রাণঘাতী সায়ানাইড! চেরি ও পিচও এই ফলের অন্তর্ভুক্ত। যদি আপেলের বীজ গিলে ফেলা হয় তবে তা পরিপাকনালী হয়ে মলদ্বার দিয়ে আস্ত দানা হিসেবে বেরিয়ে আসবে। কারণ সায়ানাইড আপেল বীজের কঠিন আবরণ ভেদ করে বের হয়ে আসতে পারে না। তবে বেরিয়ে আসবে তখনই যদি তাতে কেউ কামড় দিয়ে বসেন। তবে প্রাপ্তবয়স্ক রা কামড় দিয়ে খেয়ে ফেললে হয়তো তেমন ক্ষতি হবে না। কারণ তাদের দেহের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা তা বিষমুক্ত করতে পারবে। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে শিশুদের বেলায়।

মিষ্টিকুমড়া
যারা অনিদ্রা, স্নায়বিক উত্তেজনা বা ডিপ্রেশনে ভুগছেন তাদের জন্য মিষ্টি কুমড়া বীচি নিয়ামক বলা যেতে পারে। কেননা এতে রয়েছে ট্রিপ্টোফ্যান নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ এমাইনো এসিড যা নিদ্রাহীনতা, অবসাদগ্রস্ততা, স্নায়ুবিক উত্তেজনা নিরসনে কাজ করে। এটি মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখে। এছাড়াও এতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রোটিন, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, আয়রন, ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড, ফাইবার ও সাইটোস্টেরোলের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতি ১০০ গ্রাম বিচিতে পুষ্টিগুণ পাবেন ৫৫৯ কিলো ক্যালরি, ৩০ গ্রাম প্রোটিন, ১০ মিলিগ্রাম জিংক। এটা উচ্চ ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, মানসিক চাপ ও অনিদ্রা দূর করতে সাহায্য করে। কুমড়োর বীজ এবং কুমড়ো বীজের তেলে প্রচুর জিঙ্ক রয়েছে। যা প্রস্টেট গ্ল্যান্ড স্বাভাবিক রাখে। তাই এগুলি নিয়মিত খাবারের তালিকায় থাকলে বেশি বয়সের এই সমস্যা থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া যায়। এতে রয়েছে প্রচুর সাইটোস্টেরোল যা পুরুষের দেহে টেসটোস্টেরন হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে।

শিম
শিমের বীচিতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন বি, আয়রন ৬ ও ফাইবার। সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়, কালো শিমের বিচি কোলন ক্যান্সারে সহায়ক কোলন অ্যাডেনোমার বিপরীতে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। এ বিচি দেহের বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের মাত্রা ও অতিরিক্ত ফ্যাট নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক। এতে কোলেস্টোরেল একেবারেই নেই।

চিচিঙ্গা
এটা গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালের সুস্বাদু সবজি। চিচিঙ্গা পাকলে হলুদ বা কমলা চ্যাপ্টা ও কিনারা ঢেউ খেলানো একাধিক বীজ পাওয়া যায়। কৃমির উপদ্রব থেকে মুক্তি পেতে পাকা বীজ গুঁড়া করে প্রতিদিন ৫০০ মি গ্রা. করে মিশিয়ে খেতে হবে।

ঝিঙা
ঝিঙা বীজ এন্টিঅক্সিডেন্ট, প্রাকৃতিক প্রদাহনাশক ও ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে। এতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফ্ল্যাভোনয়েডস ও ফেনোলিক এসিড যা প্রদাহ ও ব্যথা দূর করতে সাহায্য করে।

অতএব, উল্লেখিত ফল আর সবজি বীজ এখন আর ফেলনা হিসেবে নয়, গ্রহণ করুন আপনার সুসাস্থ্যের জন্য।

সূত্র : স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ফল ও সবজির বীচি  [Women Express, ২৬ মে ২০১৭]

Similar Posts

error: Content is protected !!