নিকলীর সাঁতারু হিমেল পাড়ি দেবেন ইংলিশ চ্যানেল

বিশেষ প্রতিনিধি ।।

“প্রায় দেড় বছর ধরে চেষ্টা করছিলাম। ২০২৩ সাল থেকে প্রসেসিং শুরু করি। এরপর বিভিন্ন ধাপে ধাপে এগোতে থাকি। ভিসাটা ছিল ফাইনাল স্টেইজ। সেটা ছিল ফাইনাল রেজাল্ট। সেটি পাওয়ার পর মনে হয়েছে এখন আমি ইংলিশ চ্যানেলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। শুধু সেখানকার পানিটা টাচ করিনি, এমনটাই মনে হচ্ছে।” কথাগুলো বলছিলেন ইংলিশ চ্যানেলের জন্য জুলাই স্লটে মনোনয়ন পাওয়া বাংলাদেশী সাঁতারু মো: নাজমুল হক হিমেল। তার সাথে চলতি বছর ইংলিশ চ্যানেলে সাঁতারের জন্য মনোনীত হয়েছেন বাংলাদেশের আরেক সাবেক সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর।

এক দিন বিশ্বের কঠিনতম ইংলিশ চ্যানেলটা পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন মনে পুষতেন হিমেল। তার ইচ্ছে দেশের বাইরে দূরপাল্লার সাঁতার দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো। জুলাই স্লটে মনোনীত হয়ে ভিসা হাতে পেয়ে সেই স্বপ্ন পূরণের দিকেই এগোচ্ছেন এই সাঁতারু। ইংলিশ চ্যানেল এর আগে পাড়ি দিয়েছেন বাংলাদেশের ব্রজেন দাস ও মোশারফ হোসেন খান। তাদের কাতারে যোগ দেয়ার পথেই এখন হিমেল। আর ইংলিশ চ্যানেল সফলভাবে অতিক্রম করাই প্রধান লক্ষ্য হিমেলের।

সাঁতারু সাগর ও হিমেল (ডানে)

ইংলিশ চ্যানেল হলো ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে পৃথককারী একটি সাগর। এর উপর দিয়ে ৩৩ কিলোমিটার (২০.৫ মাইল) সাঁতার কাটা বিশ্বের সবচেয়ে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং আইকনিক ম্যারাথন সাঁতার। চলতি বছর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমের উদ্দেশে দেশ ছাড়বেন দুই সাঁতারু হিমেল ও সাগর। ১৫ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে যে কোনো দিন চ্যানেলে নামতে পারেন তারা। হিমেলের প্রস্তুতি চলছে গত দুই বছর ধরেই। তার মতে, “যদিও আমাদের দেশটি গরমপ্রধান দেশ। আর ইংলিশ চ্যানেল হচ্ছে পুরোটাই ঠাণ্ডা। প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। তবে শুধু ঠাণ্ডা পানির অভাবটা রয়ে গেছে। সেটা যদিও আমার জন্য কঠিন হবে, তবে আমাদের এলাকায় যেখানে আইস তৈরি হচ্ছে, সেখানে আইসবাথে সপ্তাহে দুই-তিন দিন প্র্যাকটিস করব। এর মধ্যে নিয়মিত চলছে রানিং-সুইমিং। ইংলিশ চ্যানেল সফলভাবে অতিক্রম করাই প্রধান লক্ষ্য আমার।”

১৯৯৭ সালে বাবা আবুল হাসেমের মাধ্যমে সাঁতারে হাতেখড়ি হিমেলের। আবুল হাসেম ছিলেন আশির দশকের জাতীয় সাঁতারু। জাতীয় সুইমিং ফেডারেশনের সাবেক সদস্য ও নিকলী সুইমিং ক্লাবের কোচ।

চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় হিমেল। কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার এই কৃতী সাঁতারুর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাঁতারে হাতেখড়ি সাবেক সাঁতারু মো: সোলায়মানের মাধ্যমে, ১৯৯৮ সালে। তারপর জাপানি কোচের অধীনে ছিলেন তিন বছর। পরের সময়টুকু চীনা কোচের অধীনে। সাঁতারের পথচলায় সব মিলে ১০ বছর এই তিনজনের অধীনেই ছিলেন হিমেল। এ সময়ের মধ্যে ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতারে ২০টি স্বর্ণ, ১৫টি রৌপ্য পদক নিজের ঝুলিতে পুরেছেন এই সাঁতারু। ২০০৬ সালে বয়স গ্রুপে নির্বাচিত হয়েছেন সেরা সাঁতারু। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অর্জন পাঁচটি স্বর্ণ ও চারটি রৌপ্যপদক। এই সময়কালে বয়সভিত্তিক সাঁতারে গড়েছেন ছয়টি জাতীয় রেকর্ড। ২০০৮ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় ইন্দো-বাংলা গেমসে এক স্বর্ণ ও দুই রৌপ্য জয় করেন।

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপি থেকে ২০০৬ সালে এসএসসি ও ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করার পর হিমেল উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান চীনে। সেখানে বেইজিং স্পোর্টস ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৯-২০১৩ সেশনে শারীরিক শিক্ষায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। একই বিষয়ে ২০১৩-২০১৬ মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এই সময়ের মধ্যে অল বেইজিং ইন্টারন্যাশনাল ফরেন স্টুডেন্টস সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১২-তে চ্যাম্পিয়ন, ২০১২ ও ১৩ সালে ৮০০ মিটার ওপেন ওয়াটার চ্যাম্পিয়নশিপ কুনমিং, চীনে এক স্বর্ণ এক রৌপ্য জয় করেন। আর সাগর হলেন ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে অংশ নেয়া সাঁতারু।

এশিয়ার সাঁতারু হিসেবে ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট প্রথম ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন ব্রজেন দাস। এরপর আরো পাঁচবার তিনি ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেছেন। সবশেষ ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বরে সবচেয়ে কম সময়ে, মাত্র ১০ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে পার হয়ে বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেন।

ব্রজেন দাসের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন মোশারফ হোসেন খান। ১৯৮৮ সালে তিনি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন। তবে ব্রজেন দাস পাকিস্তানের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রথম সাঁতারু হিসেবে এই কৃতিত্ব দেখান মোশারফ। এবার তাদের কাতারে যোগ দিতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের দুই সাঁতারু মো: নাজমুল হক হিমেল ও মাহফিজুর রহমান সাগর।

Similar Posts

error: Content is protected !!