কারার মাহমুদুল হাসান ।।
কিছু দিন ধরে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরাখবরে বিএনপির দুর্গতি, আরোপিত মামলা, জেল-জুলুমসহ কারাবন্দী নেতাকর্মীদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা সম্পর্কে রাজনৈতিক সচেতন জনগোষ্ঠী অবহিত। আর এ অবস্থায় বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে এমনকি দলের কাণ্ডারিদের অনেকের সন্দেহ, আতঙ্ক বিদ্যমান। এ অবস্থায় রাজনৈতিক কুয়াশা ও একরকম অন্ধকারে আছেন বিএনপির সমর্থক বা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশ। তারা এখন ম্রিয়মাণ এবং কেউ কেউ বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে আস্থাহীনতায় আচ্ছন্নও বটে।
বিএনপির জন্ম আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক পরে ১৯৭৯ সালে, বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী এবং ক্ষেত্রবিশেষে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গন থেকে প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, মুক্তিযোদ্ধা, অমুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিসহ লাখো লাখো সমর্থক মাত্র দুই-আড়াই বছরের মধ্যে ওই দলের প্রতিষ্ঠাতা লে. জেনারেল জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে অতি উৎসাহের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। তার শাসনকালের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছরের কিছু বেশি সময়। জিয়ার এ অভূতপূর্ব জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ ছিল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের চতুর্থ সপ্তাহে চট্টগ্রাম কালুরঘাটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশপ্রয়াসী কয়েকজন দেশপ্রেমিক কর্তৃক স্থাপিত অস্থায়ী বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে তার কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা জাতি আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারে। সেই সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈনিক ও কর্মকর্তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার খবরে সারা জাতি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উজ্জীবিত হয় আর এ সময় থেকেই জিয়া বাংলাদেশের ঘরে ঘরে অতি পরিচিত এক নাম।
এরপর ১৯৭৫ সালে সপরিবারে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খোন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হাতে তুলে নেন এবং জেনারেল সফিউল্লাহর স্থলে জিয়াকে সেনাপ্রধান করে আড়াই মাস দেশ পরিচালনা করার পর মূলত জাসদ ও কর্নেল তাহেরের উদ্যোগে ‘সিপাহি জনতার বিপ্লব’-এর ফলে ঢাকায় অবস্থানকারী সেনাবাহিনীর একাংশ খোন্দকার মোশতাককে সরিয়ে বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে আসীন করে। অন্য দিকে সিপাহি জনতা জিয়াকে বন্দিদশা থেকে (সেনাবাহিনীর একটি অংশ কর্তৃক ১ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল) বের করে এনে সশস্ত্রবাহিনী প্রায় সার্বিকভাবে তার সমর্থনে একতাবদ্ধ হয়। ‘ডিফেকটো’ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে জেনারেল জিয়া নিজের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে অতিদ্রুত। এরপর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান দেশকে বাকশাল থেকে বহুদলীয় রাজনীতির পথে ফিরিয়ে নিয়ে ১৯৭৯ সালের প্রথমার্ধে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। সে নির্বাচনে আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিল। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে বিজয় লাভ করে। তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করে। নির্বাচনের দুই বছরের মাথায় রাষ্ট্রপতি জিয়া ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরে একদল উচ্ছৃখল সেনাসদস্যের হাতে চট্টগ্রামে নিহত হন। উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দেন। বিএনপি প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তার এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত জোটের পক্ষ থেকে জেনারেল (অব:) এম এ জি ওসমানী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন। সে নির্বাচনেও বিএনপি প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ও বিচারপতি সাত্তার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোটামুটি ভালোভাবেই দেশ পরিচালনা করছিলেন।
কিন্তু তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের কূটচক্রে এবং বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও নেতার ষড়যন্ত্রে ও সমর্থনে চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে তছনছ করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক আইন জারি হয়। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে এরশাদ দায়িত্ব নিয়ে বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত করে শক্তিশালী উপজেলা ব্যবস্থা গঠনসহ বেশ কিছু অবকাঠামো ও প্রশাসনিক সেক্টরে দৃশ্যমান উন্নয়নমূলক কাজ অতিশয় ক্ষিপ্রতার সাথে শুরু করেন। সেই সাথে কবিতা লেখার কাজগুলোও সমান্তরালভাবে চালিয়ে যান। তিনি প্রায় ৯ বছর দেশ শাসন করে জাতীয় পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েক ডজন নেতা এবং কিছু নতুন মুখ তার দলে যোগ দেন।
এরশাদের প্রায় দশককালের শাসনামলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আন্দোলন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী সরকার এবং এর অধীনে নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন, এতে বিএনপির সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন, তারপর আবার নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন, সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় লাভ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন, মেয়াদ শেষে ২০০১ সালে আবার সংসদ নির্বাচন এবং সে নির্বাচনে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে ১৩১টি আসন বেশি পেয়ে জয় লাভ করে দ্বিতীয়বার খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন ইত্যাদি বিষয় দেশবাসী অবহিত। তারপর সেনাসমর্থিত ‘ভিন্ন ধাঁচে’ এক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮-এর ডিসেম্বরে নবম জাতীয় নির্বাচনে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া এবং ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ ২৩০টি সংসদ আসনে জয়লাভ করে দ্বিতীয়বার শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে সরকার গঠন করে এবং পুরো মেয়াদ দেশ পরিচালনা করেছে। তবে লক্ষ করার বিষয়, আওয়ামী লীগের এ মেয়াদে বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন বাদে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে অবস্থিত সিটি করপোরেশন (কুমিল্লা ও গাজীপুরসহ) নির্বাচনের সব ক’টিতেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। মোটা দাগে বাংলাদেশের জনগণের ধারণা, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রথম দফায় গঠিত সরকার মোটামুটি যথাসম্ভব গণতান্ত্রিক নিয়মনীতি অনুসরণে সরকার পরিচালনায় মনোযোগী ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে উভয় দলীয় সরকার আগেকার দিকদর্শন থেকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিচ্যুতি ঘটায়। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া, ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা ভবনকেন্দ্রিক ‘কচিকাঁচার আসর’ বসিয়ে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপের সুযোগ করে নিজেদের ও দলের জন্য দুর্নাম এবং সেই সাথে দেশবাসীর বিতৃষ্ণার খোরাক জুগিয়েছে। বিএনপির দ্বিতীয় মেয়াদে হাওয়া ভবনসংশ্লিষ্ট সমান্তরাল সরকার পরিচালনার ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণার প্রেক্ষাপটে জাতীয়ভাবে উল্লেখযোগ্য জনসমর্থিত দলটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয় এবং সমাজের শিক্ষিত ও গণসচেতন জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ এ দলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সমর্থন ও সহমর্মিতা হারিয়ে ফেলতে থাকে।
তা ছাড়া ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অনুষ্ঠিত (তৎকালীন বিরোধী দল) আওয়ামী লীগের সভায় বক্তৃতা দেয়ার সময় শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ, ফলে কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ বহু নেতাকর্মী মারাত্মকভাবে নিহত ও আহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ- যেখানে যেভাবে সম্ভব দল হিসেবে মূলত বিএনপি এবং এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে ঘাটে ঘাটে নাজেহাল কিংবা একধরনের ‘শাস্তি’ দেয়ার সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম গ্রহণে ব্রতী হয় মর্মে অনেকের কাছেই প্রতীয়মান। সাম্প্রতিক প্রায় তিন মাসব্যাপী অবরোধ-হরতালের সাথে বিএনপি-জামায়াতকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে বিদ্যমান আইন বিধি অনুযায়ী বিএনপি হাজার হাজার নেতাকর্মীর অনেককে জেলে পোরা হয়েছে এবং এখনো এ কার্যক্রম জোরেশোরে চলমান। আর বাকিরা গ্রেফতার, নির্যাতন ইত্যাদি এড়ানোর প্রচেষ্টা (মিছিলসহকারে সরকারি দলে যোগদানসহ) চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর।
বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ঢাকার এক পত্রিকায় বেগম জিয়ার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে (২৩-০৬-২০১৫)। তিনি বলেন, ‘সাজানো মামলায় নেতাদের বন্দী রাখা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে, দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। অনেকে বয়সে প্রবীণ। কারাগারে সুচিকিৎসার অভাবে তারাও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’ বিএনপির বিদ্যমান নাজেহাল অবস্থার প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু খবর হলো : ১. খালেদার টার্গেট দল ঢেলে সাজানো। ২. দীর্ঘমেয়াদি প্লানে বিএনপি : এখন আর আন্দোলন হরতাল-অবরোধ নয়, প্রতিদিন বছরজুড়েই মনোযোগ থাকবে সংগঠনে। ৩. সংগঠনকে পুরোদমে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন বেগম জিয়া : কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সব কমিটিই নতুন করে গড়তে চান। সেই সাথে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতি বাড়াতে ‘এক নেতার এক পদ’ রাখারও চিন্তাভাবনা। ৪. অতিসম্প্রতি তিন সিটি নির্বাচনের পর বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার পাশাপাশি পেশাজীবী সমাজের সাথেও বৈঠক করেছেন বেগম জিয়া। সেখানে দলীয় নেতা ছাড়াও পেশাজীবী প্রতিনিধিরা দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে বিএনপি প্রধানকে অনুরোধ করেন। বিগত আন্দোলনে মাঠে সক্রিয় এবং ত্যাগী ও যোগ্যদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেয়ার কথাও বলেন তারা।
সাংবাদিক সোহরাব হাসান ‘বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের এত উদ্বেগ কেন’ শিরোনামে এক লেখায় বিএনপি বিষয়ে বলেছেন, আওয়ামী ঘরানার বিভিন্ন স্তরের নেতানেত্রীরা অহর্নিশ বিএনপি নেত্রীকে শেখ হাসিনার পাঠ্যশালায় ভর্তি হতে বলা, বিএনপির দিন শেষ, মিডিয়া বিএনপিকে বাঁচিয়ে রেখেছে ও খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের যতই উজ্জীবিত করুন না কেন, বিএনপি আর শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়াতে পারবে না- এজাতীয় কথাবার্তা নিরন্তর বলে চলেছেন। সোহরাব মনে করেন, আওয়ামী নেতাদের এ ধরনের কথাবার্তা বিএনপিকে দিন দিন জনসমর্থন অর্জনে সহায়তা করছে, যা ওই দলের কাণ্ডারিরা বুঝতে অক্ষম।
অন্য দিকে আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আপাতত সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এক কিসিমের কেতাদুরস্ত মোসাহেব চাটুকার শ্রেণীর লোকজন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, সংবাদপত্র জগৎ, শিক্ষা, প্রশাসন, বিচার, আইনশৃঙ্খলা, ব্যাংকিং সেক্টর, চারুকলাসহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে উপাচার্য বা প্রায় সে পর্যায়ের পদে আসীন হয়ে আরো উচ্চতর পদ আহরণে ‘ময়দান’ অহর্নিশ চষে বেড়াচ্ছেন। বিভিন্নমুখী ধান্ধাবাজরা সুস্থ চিন্তাভাবনা করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি কিংবা নির্মোহ চিন্তাভাবনা করে সরকারকে যথাযথ পরামর্শ দিতে অক্ষম। এ জন্যই হয়তো প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি দলীয় নেতাকর্মীদের সামনে বলেই ফেললেন, ‘আমি (শেখ হাসিনা) ছাড়া আমার দলের সবাই বিক্রয়যোগ্য।’ খুবই কঠিন কথা বটে।
পাশাপাশি বিএনপির কেন্দ্রীয় ও অন্য অফিসগুলোতে মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং দু-তিনবারের বিপুল ভোটে জয়ী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পাশে যখন তারেক জিয়ার ছবি দেখা যায়, তখন বাংলাদেশের সচেতন ও দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী (বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত), শিক্ষক ছাত্র- তথা সচেতন তরুণ-তরুণী, গৃহকর্ত্রী, ব্যবসায়ী সমাজ, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ, সংস্কৃতিকর্মী তথা সুস্থ চিন্তাভাবনায় অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীর এক ব্যাপক অংশ বিস্মিত ও বিব্রত হন। ভদ্র-পরিশীলিত, মার্জিত ও সারা দেশে তৃণমূলে প্রোথিত দেশপ্রেমিক দলটি থেকে অন্য দিকে অবচেতন মনেই যেন তারা মুখ ফিরিয়ে নেন। তা ছাড়া বর্তমান সরকারকে গণ-অভ্যুথানের মাধ্যমে হটানোর জন্য যখন বিএনপি নেত্রী আহ্বান জানান, তখন এসব বিষয়ে জনগণ প্রশ্ন করতেই পারে যে, বিএনপি সরকার গঠন করলে কী কী জনকল্যাণ সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রাম গ্রহণে তৎপর হবে?
দেশবাসীকে আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে জানান দেয়া প্রয়োজন। এর আগে আমজনতা অত্যন্ত ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণার সাথে লক্ষ করেছে যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে গঠিত বিগত (২০০৯-২০১৩) সরকারের আমলে দেশের অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে বেশ কিছু ভয়ঙ্কর ধরনের জনস্বার্থবিরোধী ঘটনা যেমন- ২০১২ সালের শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি (যা এর আগে আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১)
গত আমলেও সংঘটিত হয়েছিল। ফলে ৩০-৪০ লাখ মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত গ্রাহক প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসেছিলেন এবং এর ধাক্কা সইতে না পেরে বেশ কয়েকজন আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছিলেন। বিএনপি দল হিসেবে এতদবিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করেনি বা যথাযথ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ ও ঘটনার নায়কদের চিহ্নিত করে জনগণের সমীপে এদের নাম প্রকাশে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেন, এটা এক প্রশ্ন বটে। তা ছাড়া গত কয়েক বছরে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কায়দায় লুটপাট করে নেয়ার বিষয়েও বিএনপি তেমন জোরালো কোনো প্রতিবাদ করেনি।
বিএনপির শীর্ষ কাণ্ডারিদের দলকে চাঙা করে পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের উদ্যোগ আয়োজনের লক্ষ্য যদি হয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, তবে দলের মধ্যেই গণতন্ত্র চর্চার দৃশ্যমান কিছু কাজ আগে করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তৃণমূল ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিএনপি এবং এর যে ১০-১২টি অঙ্গসংগঠন আছে, সেগুলো পুনর্গঠনে যথাসম্ভব গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, সমঝোতা ও নিজেদের মধ্যে আলোচনার প্রক্রিয়ায় কমিটি গঠনে সক্রিয়ভাবে মনোযোগী হতে হবে। একক ইচ্ছা বা অফিস আদেশ জারি করে এ ‘কর্মগুলো’ সম্পাদন পরিহার করে দল গোছানোর কাজ করলে বিএনপির ভিত্তি, কার্যক্ষমতা, জনপ্রিয়তা, জনসমর্থন পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেতে পারে এবং সে প্রক্রিয়ায় ক্রমবর্ধিত জনভিত্তি সমৃদ্ধ দলটি (যা গত দেড়-দুই বছরে সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দৃশ্যমান) কামিয়াবি অর্জন করতে পারে।
তা ছাড়া সরকার গঠনের পর আমলাতন্ত্রে ‘ওএসডি’ সংস্কৃতি বাতিল, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ ও অপসারণ নীতিমালা (আওয়ামী লীগ সরকার সম্প্রতি শুধু অপসারণ নীতিমালা আইন প্রণয়ন করেছে) বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে প্রধান নির্বাহী ও বোর্ড গঠন, পাবলিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের চেয়ারম্যান, আইন কমিশন, প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, পুলিশ, র্যাব, বিডিআর ইত্যাদির উচ্চপদে নিয়োগ নিয়মতান্ত্রিক (অনেকটা ভারতের আদলে) নীতিমালা, সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধানদের বিদেশ গমনে সফরসঙ্গী কতজন এবং কারা হবেন সে বিষয়ে নীতিমালা, বিদেশে কূটনীতিক নিয়োগে যথাযথ নীতিমালা অনুসরণ ও এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ধড়িবাজদের আমলে না আনা, সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়নের বাইরে সুনির্দিষ্টভাবে আর কী কী বিষয়ে তারা সম্পৃক্ত হবেন, সেসব বিষয়ে নীতিমালা, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের আবশ্যিক নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং এগুলোকে পর্যাপ্ত (বিভিন্ন উন্নত দেশের আদলে) স্বায়ত্তশাসন দেয়া, কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করা এবং তা করা না গেলে অন্তত দানাশস্য উৎপাদনকারীদের শস্য উৎপাদনের পর দাম আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের ইউনিয়নভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন এবং উপজেলা সদরে উপযুক্ত স্থানে তাদের নাম পাথরে খোদাই করে সংরক্ষণ, সর্বোপরি আইনের শাসন নিশ্চিত করাসহ উপরি উক্ত বিভিন্ন বিষয়ে যথাযথ আইন প্রণয়ন ও তা সার্বিকভাবে বাস্তবায়নে কী কী আইন প্রণয়ন তথা পদক্ষেপ গ্রহণে বিএনপি ব্রতী হবে- সেসব বিষয়ে এখনই আনুষ্ঠানিকভাবে মেনিফেস্টো আকারে জানাতে সক্ষম হলে আশা করা যায়, বিএনপি দল গোছানোর কাজ সম্পন্ন করে মনজিল মকসুদে পৌঁছলেও পৌঁছতে পারে।
লেখক : সাবেক সচিব ও ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কৃত ১১ জনের একজন
karar.hassan@gmail.com
সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১৩ আগস্ট ২০১৫, বৃহস্পতিবার